বাংলাদেশে সামরিক আদালতে সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার নজির ভুরিভুরি থাকলেও প্রচলিত আদালতে তা বিরলই বলা যায়। সেই ঘটনাই ঘটতে যাচ্ছে এখন।
অন্তর্বর্তী সরকার গুম তদন্তে যে কমিশন গঠন করেছে, তার ভিত্তিতে মামলার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে গত বুধবার।
তারপর তাদের গ্রেপ্তারের দাবি ওঠার পর শনিবার সেনা সদরের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হল, ২৫ জনের মধ্যে চাকরিরত ১৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে আটক রাখা হয়েছে। একজন শুধু লাপাত্তা হয়ে গেছেন।
আটক এই সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে মেজর জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের মতো কর্মকর্তাও রয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তাদের কেউ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর নেতৃত্বে ছিলেন, কেউ ছিলেন র্যাবের নেতৃত্বে।
তাদেরকে আগামী ২২ অক্টোবরের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে বলা হয়েছে। তার মধ্যে আইন মেনে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান সেনাবাহিনীর অ্যাডজুডেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান।
তার ভাষ্যে, আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এই সেনা কর্মকর্তাদের হেফাজতে রাখা হয়েছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর সেনাবাহিনী সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
গত ৮ অক্টোবর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকে আলোচনা শুরু হয় চাকরিরত এই সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের উপায় নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে, সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ ওঠে, তাহলে বিচারটি কি সামরিক আদালতে হবে, নাকি প্রচলিত ফৌজদারি আইনে হবে?
এর আগে অবশ্য গত ৬ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে একটি সংশোধনী আনে। ওই সংশোধনী অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেই ব্যক্তি সরকারি চাকরিজীবী হলে ওই পদে থাকতে পারবেন না।
অবশ্য নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় র্যাবে কর্মরত তিনজন সেনা কর্মকর্তার বিচার প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই হয়েছিল।
তবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, পেশাগত কাজের সময় সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য কোনো অপরাধ করলে তার সামরিক আইনে বিচার হবে। তবে যদি সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করেন, তখন তার বিচার সাধারণ আদালতে হতে কোনো বাধা নেই।
একাধিক কর্মকর্তার বক্তব্যের বরাতে বিবিসি বাংলা বলছে, হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতি এই তিনটি অপরাধে একজন সেনা কর্মকর্তা বা সদস্যের বিচার প্রধানত প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে করতে হবে। কিন্তু, যদি সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন মনে করে, তবে এই তিনটি অপরাধের বিচারও সেনা আইনে করা যায়। এজন্য সেনা আইনে সেনাপ্রধানকে সে ক্ষমতা দেওয়া আছে।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ফৌজদারি অপরাধের বিচার হওয়ার কথা সিভিল কোর্টে। তবে সামরিক আইনে বিচার করতে হলে ওই কোর্টের বিচারকের অনুমতি সাপেক্ষে তা সামরিক কোর্টে নিয়ে আসা যায়। এক্ষেত্রে দুইটি অপশনই রয়েছে।”
২০১৪ সালে সাত খুনের মামলায় যেসব সেনা কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছিলেন, তাদের বিচার সেনাবাহিনীর আইনে করা নিয়ে আইনি প্রশ্ন উঠেছিল। তখন সেনাবাহিনী ওই তিন কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠায়, তাতে বিচারেরর বাধা কাটে। কারণ অবসরপ্রাপ্তদের বিচার সামরিক আদালতে হয় না।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেছিলেন। তবে সেই আবেদন খারিজ করে দেয় ট্রাইব্যুনাল।
সাত খুনের মামলাকে নজির হিসেবে দেখিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম বলেছেন, সংবিধান ও ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার ট্রাইব্যুনালে হতে বাধা নেই।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংবিধান দ্বারা প্রোটেক্টেড। অন্য যে কোনো আইন এই আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হলে সেই আইন বাতিল হবে।”
তিনি জানান, যে কোনো সিভিলিয়ান বা ডিসিপ্লিনারি ফোর্সের বিচার এই আইনে করা যাবে।
“এই আইন তৈরির শুরু থেকেই আর্মিদের বিচার করার পাওয়ার আছে। কর্মরত হলেও আর্মিদের বিচার সেনা আইনে করার কোনো সুযোগ নেই। বিচার এই আইনেই হতে হবে।”
এদিকে আটক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নতুন করে কোনো তদন্তের প্রয়োজন সেনাবাহিনী দেখছে না। মেজর জেনারেল হাকিমুজ্জামান বলেন, “গুম কমিশন কাজ করছে। আর্মি আরেকটা কমিশন করলে সেটাকে আন্ডারমাইন করা হবে। এই কমিশনকে যতটুকু সাহায্য করার সেটা করছি।”
সেনা আইনে না কি প্রচলিত আইনে বিচার হবে- সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ও সেনা আইন মুখোমুখি করতে চান না।
প্রশ্নের পিঠে তিনি বলেন, র্যাব ও ডিজিএফআই সেনাবাহিনীর অধীনে না। র্যাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ডিজিএফআই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে। তাই অভিযুক্তরা সেনা কর্মকর্তা হলেও সেখানে সেনাবাহিনীর কথা বলার এখতিয়ার নেই।