ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ অভিযান এখনও চলছে। দেশটির একটা বড় অংশই এখন রুশ সেনাদের দখলে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা করলেও, ইউরোপ এখনও ইউক্রেনকে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
আর এতে সামরিক চাপ বাড়ছে রাশিয়ার উপর। মস্কো এই চাপ কমাতে তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে একটি নতুন ইউনিট তৈরি করেছে। ইউনিটটি পশ্চিমা দেশগুলোতে গোপনে হামলা চালাচ্ছে, এমনটা বলছে পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
রাশিয়ায় অভ্যন্তরীণভাবে ‘ডিপার্টমেন্ট অব স্পেশাল টাস্ক’ নামে পরিচিত ওই ইউনিটটি। এটি মস্কোর বাইরে ‘অ্যাকুরিয়াম’ নামে কাচ ও ইস্পাতে ঘেরা একটি বিশাল কমপ্লেক্সে রাশিয়ার সামরিক-গোয়েন্দা সদরদপ্তর থেকে কার্যক্রম চালায়।
ইউনিটটির অধিকাংশ গোপন অপারেশন নিয়ে আগে কোনো প্রতিবেদন হয়নি। এর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, সাবোটাজ ও বিমানে আগুন ধরে যায় এমন ডিভাইস বসানোর অভিযোগ আছে।
পশ্চিমা কর্মকর্তাদের মতে, রাশিয়ার চলমান যুদ্ধকালীন বাস্তবতাতেই এই ইউনিটের সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৩ সালে এটি ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা সমর্থনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে গঠিত হয়। এতে রাশিয়ার সাম্প্রতিক বছরগুলোর সবচেয়ে গোপন অপারেশনগুলোর অভিজ্ঞ সাহসী সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন দুই ইউরোপীয় গোয়েন্দা প্রধান এবং যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও রাশিয়ার নিরাপত্তা কর্মকর্তারা।

ক্রেমলিন পশ্চিমকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের হামলায় সহযোগী হিসেবে দেখে, যেমন নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে সাবোটাজ, মস্কোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের হত্যা ও পশ্চিমা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনের আক্রমণ। ইউক্রেন নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের সাবোটাজের জন্য দায়ী, এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
হাইব্রিড যুদ্ধের জন্য দায়ি ন্যাটোর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল জেমস অ্যাপাথুরাই বলেন, “রাশিয়া মনে করে তারা সামগ্রিক পশ্চিমের সঙ্গে সংঘাতে রয়েছে এবং সে অনুযায়ী আচরণ করছে। এমনকি পরমাণু হামলার হুমকি দেওয়া ও তার সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে।”
রাশিয়ার এই নতুন গোয়েন্দা ইউনিটকে পশ্চিমা গোয়েন্দারা এসএসডি নামে চেনে। তারা মনে করে, পশ্চিমে সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি হামলার পেছনে দায়ি এসএসডি। এর মধ্যে রয়েছে একটি জার্মান অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর হত্যাচেষ্টার ঘটনা এবং শিপিং জায়ান্ট ডিএইচএলের বিমানে আগুন ধরে যায় এমন ডিভাইস রাখার পরিকল্পনা।
রাশিয়ার বিভিন্ন গুপ্তচর সংস্থার সদস্যদের নিয়ে এসএসডি গঠিত হয়েছে। ইউনিটটি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি থেকে কিছু ক্ষমতা পায়। আর এফএসবি ‘ইউনিট ২৯১৫৫-কে’ নামে ইউনিটটিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। পশ্চিমা গোয়েন্দাদের মতে, ২০১৮ সালে ব্রিটেনে রুশ ডাবল এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপালের বিষক্রিয়ায় জড়িত ছিল ইউনিটটি।
পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, এসএসডির অন্তত তিনটি মূল কাজ রয়েছে: বিদেশে হত্যাকাণ্ড ও সাবোটাজ চালানো, পশ্চিমা কোম্পানি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশ করা এবং বিদেশি এজেন্টদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া। এই বিভাগটি ইউক্রেন, উন্নয়নশীল দেশ এবং রাশিয়ার প্রতি অনুকূল দেশগুলো থেকে এজেন্ট সংগ্রহের চেষ্টা করছে, যেমন সার্বিয়া। এছাড়া ইউনিটটি ‘সেনেজ’ নামে একটি কেন্দ্র চালায়। সেখানে রাশিয়া তার বিশেষ বাহিনীগুলোর প্রশিক্ষণ দেয়।
এসএসডির অপারেশন পরিচালনার দায়িত্বে আছেন কর্নেল আন্দ্রে ভ্লাদিমিরোভিচ অ্যাভেরিয়ানভ এবং তার উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইভান সেরগেইভিচ কাসিয়ানেনকো। অ্যাভেরিয়ানভ চেচন যুদ্ধের একজন অভিজ্ঞ সেনা কর্মকর্তা। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে ক্রিমিয়া দখল ও সংযুক্তিতে অংশগ্রহণের জন্য রাশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মান, ‘হিরো অফ রাশিয়া’ মেডেল দিয়েছেন।

পশ্চিমা গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন, কাসিয়ানেনকোকে অ্যাভেরিয়ানভের উপদেষ্টা হিসেবে ব্রিটেনে সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার কন্যা ইউলিয়াকে বিষক্রিয়া করার অপারেশনে যুক্ত করা হয়েছিল। স্ক্রিপাল ও তার মেয়ে বিষক্রিয়ার পর বেঁচে গেলেও গুরুতর অসুস্থ হয়ে যান। তবে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে একজন নারী মারা গিয়েছিলেন। কারণ তিনি আক্রমণকারীরা ফেলে দেওয়া বিষাক্ত পারফিউম বোতলটি তুলে নিয়েছিলেন। রাশিয়া অবশ্য বিষক্রিয়ায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ইউরোপে গোপন অপারেশন পরিচালনা এবং ২০২৩ সালে ওয়াগনারের প্রতিষ্ঠাতা ইভজেনি প্রিগোজিনের হত্যার পর আফ্রিকায় ওয়াগনারের প্যারামিলিটারি অপারেশনগুলো দখলের দায়িত্বে ছিলেন কাসিয়ানেনকো। তিনি ১৯৭৫ সালে কাজাখস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্রু নামে পরিচিত রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে কাজ করেছিলেন এবং অভ্যন্তরীণভাবে তাকে কেআইএস নামে ডাকা হয়।
ইরানের একজন কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন, কাসিয়ানেনকো সম্প্রতি রাশিয়া থেকে ইরানে প্রযুক্তি ও দক্ষতা স্থানান্তর করতে সহায়তা করেছেন। তেহরান মস্কোর ইউক্রেন যুদ্ধে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে।
কাসিয়ানেনকোকে আগে চিহ্নিত করেছিলেন সাংবাদিক ক্রিস্টো গ্রোজেভ। তিনি অনলাইন নিউজ আউটলেট দ্য ইনসাইডারের জন্য একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন।
গ্রোজেভ জানান, তিনি প্রথমে আফগানিস্তানে তালেবানের শাসন নিয়ে সম্প্রতি একটি ডকুমেন্টারিতে গ্রু অপারেটদের চিহ্নিত করেছিলেন, ‘হলিউডগেট’ শিরোনামে। এরপর তিনি এক অপারেটরের ফোন রেকর্ড পান, যেখানে দেখা যায়, ওই অপারেটর কাসিয়ানেনকোর সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত ডিসেম্বরে এসএসডির নাম উল্লেখ না করেই ওই ইউনিটের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়। অভিযোগ দেয় ইউরোপ এবং অন্যান্য জায়গায় ‘বিপ্লব, হত্যাকাণ্ড, বোমাবর্ষণ ও সাইবার আক্রমণ’ সংগঠিত করার জন্য। ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রও এসএসডির সদস্যদের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ আনে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইউক্রেনে সাইবার আক্রমণের জন্য অভিযুক্ত পাঁচ সদস্যের সম্পর্কে যে কোনো তথ্যের জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের মতে, এসএসডির শত্রুতা গত গ্রীষ্মে শীর্ষে পৌঁছেছিল, তবে সম্প্রতি তা কমে গেছে। দুই ইউরোপীয় গোয়েন্দা প্রধানের মতে, এই সক্রিয়তার স্থিতিশীলতা মস্কোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার জন্য কূটনৈতিক জায়গা তৈরি করে দিতে পারে।

ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংস্থা গত মে মাসে জানায়, তারা রাশিয়ার একটি পরিকল্পনা ব্যর্থ করেছে, যেখানে কয়েকটি সুপারমার্কেট ও একটি ক্যাফে পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ইউক্রেন জানিয়েছে, এই পরিকল্পনাটি মেজর ইউরি সিজভ সমন্বয় করেছিলেন।
পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, সিজভ হলেন সেনেজের একজন কর্মকর্তা। বর্তমানে এসএসডির হয়ে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশর একটি শপিং মল আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
তারপর গত জুলাইয়ে ডিএইচএলের মাধ্যমে পাঠানো অগ্নিসংযোগকারী ডিভাইস জার্মানির লিপজিগ ও ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের ট্রানজিট হাবগুলিতে বিস্ফোরিত হয়। জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান থমাস হালডেনওয়াং গত অক্টোবরে আইনপ্রণেতাদের জানান, অগ্নিসংযোগকারী ডিভাইসের একটিও যদি উড়োজাহাজে বিস্ফোরিত হলে সেটি ধ্বংস হয়ে যেত। ফ্লাইট দেরি হওয়ায় উড়োজাহাজে ডিভাইসটি বিস্ফোরিত হয়নি।
নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলেন, জুলাইয়ে বিস্ফোরিত অগ্নিসংযোগকারী ডিভাইসগুলো সম্ভবত উত্তর আমেরিকার উড়োজাহাজগুলোতে অনুরূপ ডিভাইস স্থাপনের একটি পরীক্ষামূলক চেষ্টা ছিল। আগস্টে প্রধান শিপিং কোম্পানি, এয়ারলাইন্স এবং বিমানবন্দরগুলোকে গোপনে সতর্কতা পাঠানো হয়। এর ফলে কিছু প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা স্ক্রিনিং বাড়ায়।
২০২৪ সালের গ্রীষ্মের শেষের দিকে আবিষ্কৃত পরিকল্পনার বিস্তারিত প্রথমে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল রিপোর্ট করেছে। হুমকিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান ও সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির প্রধান উইলিয়াম বার্নস আগস্টে রুশ নেতাদের ফোন করে হামলা বন্ধ করার অনুরোধ করেন বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ কর্মকর্তারা। এই ফোনালাপ প্রথমে নিউ ইয়র্ক টাইমস রিপোর্ট করেছিল।
সুলিভান রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সহযোগী ও সাবেক রাষ্ট্রদূত ইউরি উশাকোভকে ফোন করেন। আর বার্নস তার সমকক্ষ সের্গেই নারিশকিন ও রাশিয়ার শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা সের্গেই শোইগুকে ফোন করেন।
পুতিনঘনিষ্ঠ শোইগু এবং উশাকোভ ডিএইচএল পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনো তথ্য থাকার কথা অস্বীকার করেন।
এসএসডি সরাসরি পুতিনের আদেশে কাজ করে। ইউনিটটি বিশেষভাবে জার্মানির প্রতি মনোযোগী কারণ রাশিয়া জার্মানিকে ন্যাটোতে একটি দুর্বল জায়গা হিসেবে দেখে।
গত বছরের মে মাসে এসএসডি অপারেটররা জার্মানির বার্লিনে ডিয়েহল কোম্পানির একটি কারখানায় অগ্নিসংযোগ করে। ওই কোম্পানি ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা।

একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা জার্মানিকে জানায় যে তারা ইউরোপের অস্ত্রশিল্প নেতাদের হত্যার একটি পরিকল্পনা উদঘাটন করেছে। এর মধ্যে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় কামান গোলাবারুদ সরবরাহকারী রেইনমেটালের প্রধান নির্বাহী আর্মিন প্যাপারগারও রয়েছেন। তিনি ইউক্রেনে একটি ট্যাংক কারখানা নির্মাণ করছেন।
ইউরোপের অন্যত্রও হামলা হয়েছে। গত জুনে ফরাসি কর্তৃপক্ষ এক ইউক্রেনীয়-রাশিয়ান নাগরিককে গ্রেপ্তার করে। তার হোটেল রুমে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। ফরাসি কর্তৃপক্ষ তাকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত অভিযোগে অভিযুক্ত করে।
কিছু আইনপ্রণেতা এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তারা রাশিয়ার অপারেশনগুলোর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোকে গোপন প্রচেষ্টা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক প্যারামিলিটারি কর্মকর্তা নিক থম্পসন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিজস্ব গোপন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে রাশিয়া ও এর আশপাশে বাড়াতে ও ব্যবহার করতে হবে। এতে ক্রেমলিনের আরও আগ্রাসন রোধ করা যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান সেনেটর টম কটন (আরকানসাস) বলেন, “সিআইএকে গোপন কর্মকাণ্ডে আরও সাহসী ও উদ্ভাবনী হতে হবে।”
তথ্যসূত্র : ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, নিউ ইয়র্কার, নিউ ইয়র্ক টাইমস।