হাইওয়ের পাশে পেট্রোল পাম্প কাম কফিশপে বসে আছি। কফি মগের টুংটাং আর রাস্তা তেড়েফুড়ে বেরিয়ে যাওয়া চাকার শব্দের সঙ্গম মন্দ না। লাগছে বেশ। অতি পরিচিত। আমাদের ওখানকার মতোই।
আসলে শব্দের কোনো জাত নেই, পাত নেই হয়তো। পৃথিবীর সব প্রান্তে প্রায় একই সিম্ফনি! শুধু একারণে লঙ্কার পাখিরা লাইবেরিয়ার কিংবা নরডিকের পাখিদের ডাকেও নির্বিঘ্নে সাড়া দেয়। হয়তো একারণে আমার মেয়ে ‘ভাষাহীন’ পৃথিবী কল্পনায় আঁকে। যাক, ওটা ভিন্ন প্রসঙ্গ!
বাইরে তাপমান শূন্য। অবশ্য গত কয়দিন মাইনাসেই ছিলাম। মাথার উপর ঝুলছে টেলিভিশন। দেখতে হলে নিতান্তই ঘাড়ের কসরত ছাড়া উপায় নেই। অন্তত পয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে উঁচু করলে তবেই দেখা মিলবে পর্দার। খবর চলছে। আমার পাশ-আশে আর না হলেও দশটি টেবিলজুড়ে লোকজন আছেন। খবরের প্রতি বিন্দুমাত্র কারও আগ্রহ নেই। বিষয়টা এমন না যে ওরা খবরবিমুখ। সত্যি বলতে ওদের প্রায় সব বাসাবাড়িতে এখনও কাগজের পত্রিকাই নিয়মিত যায়। দিনরাত রেডিও চলে! পঞ্চম প্রজন্মের নেটওয়ার্ক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ওরা কিন্তু আমাদের মতো গড়পড়তা সবাই ‘কন্টেন্ট’ তৈরিতে নিমগ্ন নয়। আমাদের মতো সবাই সেলিব্রিটিও হতে চায় না। নিজেকেই প্রাধান্য দেয় ওরা।
যাই হোক, এই মুহূর্তে নিজেকে বিলুপ্ত শ্রেণির কিছু একটা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ফর্সা গালে আমি একটা অপ্রাসঙ্গিক কালো তিল! কেন বলছি? এত এত সাদাদের ভিড়ে আমি একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ। এখানে এমন অনেক কিছুই মনে হয়! হয় আরকি! আমার থেকে পাঁচ টেবিল পরেই যে মেয়েটি একা বসে আছে বরং তাকে নিয়েই কিছু লিখি। চায়েনিজ নাকের ফিনিশ। ভারী ফাউন্ডেশন আর মোটা ঠোঁটে কালো লিপস্টিকের আঁচড় কী অদ্ভুত যে লাগছে। হালকা কার্ল শেইপড ব্রাউন চুল। গায়ে ব্ল্যাক ওভারকোট আর ‘সলিড ওপেইক টাইটসের’ কম্বিনেশনটাও অসাধারণ। গলায় আনস্টিচ রাউন্ড গলাবন্ধনী। ইচ্ছে হচ্ছে পাশে গিয়ে বসে বলি- তুমি কোন পাড়ার মেয়ে গো? ভারি অদ্ভুত তোমার চাহনি। হা হা হা।
অদ্ভুত বিষয় হলো, এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কফি সেবনকারী। এজন্য কর্মঘণ্টায় ১৫ মিনিট কফিব্রেকটা কিন্তু বাধ্যতামূলক!
মেয়েটার কথা ভাবছিলাম, আর তখনই ‘ইউহো’ কানের কাছে এসে বলে উঠলো- হেই ম্যান, হোয়াটস আপ? মিতেন মেনে? ইউহো এই কফিশপের একটা স্পেশাল কেরেক্টার। দুর্দান্ত ব্রিটিশ একসেন্টে ইংরেজি বলে। আমাকে নাগালে পেলেই ‘এনার্জি কনজারভেশন’ বিষয়ক নানা প্রশ্নে জেরবার করে ফেলে। এখানে কাজ করার পাশাপাশি নিজে নিজে প্রোগ্রামিং নির্ভর বিভিন্ন প্রজেক্ট করে সে। কয়েক মাস আগে ওকে একটা আইডিয়া দিয়েছিলাম। প্রজেক্টটা ছিল ‘এনার্জি সোয়াইপ’! ব্যাটারিচালিত ভেহিক্যালের মধ্যে এনার্জি শেয়ারিং। অফপিকে ব্যাটারি বিনে পয়সায় চার্জড করে পিক আওয়ারে বিক্রি করে দেওয়া। ও এই প্রাথমিক ধারণা নিয়ে রীতিমত একটা ‘এন্ড্রোয়েড অ্যাপস’ বানিয়ে ফেলছে। যেজন্য এই বর্ণনা তার কারণ হলো, এখানে কমবেশি সবাই কোডিংটা জানে। স্কুল থেকেই শেখানো শুরু হয়ে যায়। ‘টেন মিনিটস’ কোচিং সেন্টার বা কনটেন্ট বানিয়ে পয়সা কামানোর ফন্দি তেমন চোখে পড়ে না।
যাইহোক, কফিশপে ফিরে আসি। লিখতে লিখতে আশপাশের টেবিল প্রায় ফাঁকা। এই ফাঁকেই নিতম্ব দোলাতে দোলাতে বিএমডব্লিউ চেপে চলে গেল সেই মেয়েটি! আজ উইকএন্ডের শুরু। সুতরাং হয়তো চলে গেছে কোনো নাইটক্লাবে, হয়তো ডেটিংয়ে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। হয়তো অন্যকিছু। আর যাইহোক ওরা বাঁচতে জানে।
কফিশপে বসে আছি, তাই কফি সম্পর্কিত তথ্য না দিলেই নয়। লেখাটাও পূর্ণতা পাবে না হয়তো। অদ্ভুত বিষয় হলো, এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কফি সেবনকারী। এজন্য কর্মঘণ্টায় ১৫ মিনিট কফিব্রেকটা কিন্তু বাধ্যতামূলক! তার মানে এই নয় যে, ওরা কফি সেবন করে বলেই সুখী জাতি! এখানে লাইব্রেরিতে যেমন ফাঁকা ‘সিট’ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, তেমনি ওরা মদ-টদও বেশ টানে। আমি মেলাতে পারিনা ওদের আসলে কীসে বেশি টানে! যেমন মেলেনা আমার টানাটানি…