খোদ রাজধারীতে মব জাস্টিসের শিকার হলেন দুই তরুণী। তা নিয়ে যখন শোরগোল উঠল; তখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম সামনে আনলেন ওই দুই তরুণীর প্রকাশ্যে ধূমপানকে। তা নিয়ে যখন শুরু হলো বিতর্ক, তখন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঘটনাটি চাপা দিতে চাইলেন এই বলে যে এনিয়ে দুই পক্ষের আপস হয়ে গেছে।
ঢাকার লালমাটিয়ায় গত ১ মার্চ সন্ধ্যায় একটি চায়ের দোকানে বসে ওই দুই তরুণী ধূমপানের সময় এক ব্যক্তি তা নিয়ে আপত্তি তোলেন। তা নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ওই দুই তরুণীকে লাঞ্ছিত করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে।
গত বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক অরাজক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল দেশে। সরকারশূন্য অবস্থায় সারাদেশে আক্রান্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক, হিন্দু সম্প্রদায়।
তিন দিন বাদে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরও পিটিয়ে হত্যা্র কয়েকটি ঘটনা ঘটে। তারপর তা কিছুটা কমে এলেও গত মাসে আবার বঙ্গবন্ধু ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি-ঘরে হামলা হয়।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে সরকার চাপে থাকার মধ্যে লালমাটিয়ার ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ওই দুই তরুণী প্রকাশ্যে ধূমপানের বিষয়টি সামনে আনেন।
অবসরপ্রাপ্ত এই লেফটেন্যান্ট জেনারেল বলেন, “দুই নারীর ওপর যে হামলা হয়েছে, ওনারা দুজন নাকি সিগারেট খাইতেছিল। কিছু লোক নাকি নামাজ পড়তে যাচ্ছিল। এ সময় বাধা দেয়ায় তাদের ওপর চা ছুড়েছে।
“তো আপনারা জানেন ওপেন জায়গায় সিগারেট খাওয়া নারী-পুরুষ সবার জন্য নিষেধ। এটা কিন্তু একটা অফেন্স। এজন্য আমি অনুরোধ করব, ওপেন যেন কেউ সিগারেটটা না খায়।”
তার ওই বক্তব্যের ব্যাপক সমালোচনা ওঠে অনলাইনে-অফলাইনে। এই বক্তব্য মবের পক্ষে উসকানি হিসাবে চিহ্নিত করে লালমাটিয়ায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কুশপুতুলও পোড়ানো হয়।
তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলার মধ্যে মঙ্গলবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে এনিয়ে কথা বলেন পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, “ওই ঘটনা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে, এটার ব্যাপারে উভয় পক্ষ পুলিশের সামনে আপসনামায় স্বাক্ষর করেছে, তাই ওটাকে চূড়ান্ত বলে গণ্য করতে হচ্ছে।”
আইনজীবী রিজওয়ানা আরও বলেন, “ওই ঘটনায় উভয়পক্ষই মনে করছে কথা কাটাকাটির একটা পর্যায়ে ঘটেছে। এটাকে তারা অপরাধ হিসেবে নিচ্ছে না। উভয়পক্ষ মীমাংসা করে নিয়েছেন। আর এগোতে চাচ্ছে না।”
অধিকারকর্মী হিসাবে সরব থাকা রিজওয়ানার উপদেষ্টা হিসেবে দেওয়া এই বক্তব্য দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা হিসেবে দেখছেন অনেকে।
প্রশ্ন উঠেছে, ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রেও আপসের বিধান থাকলেও আইনে এটাও আছে, কোনো আপস যদি ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্ররোচনা বা জোরপূর্বক করা হয়, তবে তা আপস হিসেবে বিবেচিত হবে না।
লালমাটিয়ার ঘটনাটি আপস কীভাবে হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাছাড়া এমন ঘটনা দেখেও সরকার নীরব থাকতে পারে কি না, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেছেন যে নারীর প্রতি সহিংসতা সরকার সমর্থন করে না; যদিও সম্প্রতি নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করার ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তানিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও খবর প্রকাশিত হয়েছে।
অভ্যুত্থানের পর মাজারে হামলা, গানের অনুষ্ঠান বন্ধের ঘটনা ঘটেছে বহু এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া হুঁশিয়ারির পরও তা ঘটেছে।
সরকার মব জাস্টিস ও মোরাল পুলিশিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে, উপদেষ্টা রিজওয়ানা একথা বললেও সেই কঠোরতা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না।
না দেখার কারণ দেখিয়ে তিনি বলেন, “যেহেতু এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের অবস্থায় আমরা ফেরত আনতে পারিনি, আসেনি। সেক্ষেত্রে কোনো কোনো জায়গায় মব জাস্টিস এবং মোরাল পুলিশিংয়ের ঘটনা ঘটেছে।”
প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রশ্নের মুখে রিজওয়ানা নিজের সরকারের সাফাই গাইতে গিয়ে বলেন, “অতীতে দলীয় সরকারের সময়ও মব জাস্টিস ও মোরাল পুলিশিংয়ের ঘটনা ঘটত।”
যা ঘটেছিল লালমাটিয়ায়
লালমাটিয়ায় আড়ংয়ের পশ্চিম পাশে একটি মাঠ রয়েছে, সেই মাঠের কোনায় রয়েছে বেশ কয়েকটি চাপের দোকান।
১ মার্চ সন্ধ্যায় লালমাটিয়া একটি চায়ের দোকানে বসে দুই তরুণী চা ও ধূমপান করছিলেন। তখন সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় একজন ব্যক্তি তাদের ধূমপান নিয়ে আপত্তি করে দোকান বন্ধ করতে বলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ হতে পাওয়া যায়।
এনিয়ে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, দোকান বনন্ধ করতে বলার পর ওই ব্যক্তির সঙ্গে দুই তরুণীর কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তাদের একজন ওই ব্যক্তির গায়ে চা ছুড়ে মারেন বলে পুলিশ জানিয়েছে; যদিও ওই তরুণীদের দাবি, ওই ব্যক্তি তাদের অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেওয়ার কারণে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে চা ছুড়েছিলেন।
এরপর ওই ব্যক্তি আরো লোকজন নিয়ে এসে সেখানে জড়ো হতে শুরু করলে দুই তরুণী চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু লোকজন তাদের ঘিরে ফেললে ওই ব্যক্তি ও তার সাথে জড়ো হওয়া ব্যক্তিরা দুই তরুণীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে মোহাম্মদপুর থানায় নিয়ে যায়। পরে পরিবারের জিম্মায় েছড়ে দেয়।
ওই তরুণীদের একজন ফেইসবুকে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিখেছিলেন, মব জড়ো হয়ে এক পর্যায়ে তাদের একটি গেইটের ভেতর আটকে ফেলেছিল। তার সঙ্গীকে শারীরিকভাবে আঘাত করা হয় এবং তাকে বাঁচাতে গিয়ে তিনিও হেনস্থার শিকার হন। তাদের পোশাক ধরেও টানাটানি করা হয়।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী এক তরুণ ফেইসবুকে লিখেছেন, “লালমাটিয়ার ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে আমি সেখানে পৌঁছাই। উপস্থিত মানুষকে শান্ত করতে গেলে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে, একশো থেকে দেড়শো মানুষের একটি মব আমাকে ঘিরে ধরে। গালাগালির সহিত ‘এই পোলা ওদের বাঁচাতে আসছে’, ‘ওরে ধর’, ‘ওরে বাইর কর’ ইত্যাদি বাক্যবাণে আমাকে জর্জরিত করা হয়। কিছু ধাক্কা, টানাটানির শিকার আমি হই আমি।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সমালোচনা
ওই ঘটনার পরদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের পর কড়া সমালোচনা আসে।
সাংবাদিক সাঈদা গুলরুখ বলেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ঠাট্টার ছলে করা মন্তব্য শুধু দুইজন নারীর উপর শারীরিক আক্রমণের অপরাধকে আড়াল করেনি, হেনস্থার শিকার নারীদের, মানে ভিক্টিম ব্লেমিংও করেছেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ধূমপান ও তামাকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের অপব্যাখ্যা করছেন বলেও সমালোচনা ওঠে।
এই আইন অনুযায়ী, পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান নিষিদ্ধ হলেও তা নির্ধারণ করে দিতে হয়। সেই জনপরিসরে ধূমপানের ক্ষেত্রে অনধিক ৩০০ টাকা জরিমানা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, ওই তরুণীরা যে চায়ের দোকানে ছিল, সেটি মাঠের এক কোনায়, সেটি কোনো পাবলিক প্লেস নয়।
ওই দুই তরুণী যদি পাবলিক প্লেসেও ধূমপান করতেন, সেক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে তাদের ওপর হামলা চালাতে পারে না।
“কারও অভিযোগ থাকলে সেই ব্যক্তি ৯৯৯ এ কল দিয়ে পুলিশকে জানাতো পারত। সেটি না করে তারা তরুণীদের ওপর হামলা করেছে। পুলিশের উচিৎ ছিল হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করা,” বলেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
আপসের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, “পুলিশ যেহেতু ঘটনাস্থলে গেছে, দেখেছে তরুণীদের ওপর কারা হামলা করেছে।
“দুই তরুণীকে শারীরিকভাবে আঘাতের জন্য দায়ী ব্যক্তিকে পুলিশের গ্রেপ্তার করা উচিৎ ছিল। কারণ আইন অনুযায়ী এটি স্পষ্টতই অপরাধ।”
লালমাটিয়ার এই ঘটনার পর মব জাস্টিস ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে দায়ী করে তার কুশপুতুল পোড়ানো হয় ৩ মার্চ। ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে এই কর্মসূচি েথকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগসহ জননিরাপত্তা নিশ্চিতে ৯ দফা দাবি জানানো হয়।