জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ তো মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বৈধ বলেই মনে করে না, ফলে উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে তাদের মাথাব্যথাও নেই। কিন্তু ইউনূস সরকার যাদের সম্মতিতে গঠিত হয়েছিল, তারাই এখন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নিয়ে আপত্তি তুলেছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মতভেদ দূর করতে ইউনূস যখন বৈঠকে ডাকলেন, তখন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তিনটি দলই কিছু উপদেষ্টাকে নিয়ে তাদের আপত্তি জানিয়ে এসেছে।
তবে কোন কোন উপদেষ্টাকে নিয়ে কার আপত্তি, তা দলগুলো খোলসা করছে না। তবে এটা স্পষ্ট এই তিনটি দলের একেকটির অভিযোগ একেক উপদেষ্টাকে নিয়ে। তবে তারা মুখ না খোলায়, এটা স্পষ্ট হচ্ছে না, উপদেষ্টাদের মধ্যে কে কোন দলের বিরাগভাজন হয়েছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্তর্বর্তী সরকারগুলোর মধ্যে ইউনূসের পরিষদই সবচেয়ে বড়। তার উপদেষ্টা পরিষদে তিনিসহ রয়েছেন মোট ২৩ জন।
গত মঙ্গলবার যমুনায় গিয়ে ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বেরিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কথাও আমরা বলেছি। সরকারের মধ্যে যদি কোনো দলীয় লোক থেকে থাকেন, তাকে অপসারণ করার জন্য আমরা দাবি জানিয়ে এসেছি।”
কোনো উপদেষ্টার কথা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেছেন কি না- এই প্রশ্নে ‘না’ সূচক জবাব দেন তিনি। তবে এর আগে বিএনপি উপদেষ্টা পরিষদে থাকা অভ্যুত্থানের দুই তরুণ তুর্কি মাহফুজ আলম এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার অপসারণ চেয়েছিল।
মঙ্গলবারের বৈঠকে থাকা একটি সূত্রের বরাতে প্রথম আলো জানাচ্ছে, সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার একজন বিশেষ সহকারীর একটি দলের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে তাদের অপসারণ চেয়েছে বিএনপি।

বিএনপির বন্ধু থেকে এখন শত্রুতে পরিণত হওয়া জামায়াতে ইসলামীও পরদিন ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে গিয়ে কিছু উপদেষ্টার বিষয়ে তাদের আপত্তি জানিয়ে আসে।
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সেদিন সাংবাদিকদের বলেন, “যারা উপদেষ্টা, তাদের ব্যাপারে বলেছি, সকলের ব্যাপারে নয়। আমরা বলেছি, আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে। কিন্তু কিছু লোক আপনার পাশে আপনাকে বিভ্রান্ত করে এবং ওরা কোনো একটা দলের পক্ষে কাজ করে আমরা মনে করি। তাদের ব্যাপারে আপনাকে হুঁশিয়ার থাকা দরকার।”
বিএনপি তাদের ভাষায় বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিতে বললেও জামায়াত এখনই এত কঠোর অবস্থান নেয়নি। তারা বলছে, এক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টাকে সময় দিচ্ছে তারা।
উপদেষ্টা পরিষদে কাদের নিয়ে জামায়াতের আপত্তি, তা অস্পষ্ট হলেও বিএনপির আপত্তি যাদের নিয়ে, জামায়াতের আপত্তি যে ভিন্নদের নিয়ে, তা স্পষ্ট। কারণ, জামায়াত আগে থেকে অভিযোগ করে আসছে, কিছু উপদেষ্টা বিএনপির প্রতি পক্ষপাত করছে। যারা করছে, তাদের টেলি সংলাপের রেকর্ড পাওয়ার দাবিও করেছে জামায়াত, কিন্তু কীভাবে তা পেল, তার ব্যাখ্যা দেয়নি।
বুধবার জামায়াতের পরপরই এনসিপি গিয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাড়ি যমুনায়। তারাও তাদের অপছন্দের উপদেষ্টাদের নিয়ে নালিশ জানিয়ে আসে।
অভ্যুত্থানকারী তরুণদের গড়া দলটির আহ্বায়ক, যিনি নিজেও এক সময় এই উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন, সেই নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি যে প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে যারা পরিচিত, তারা নিজেদের মধ্যে প্রশাসন, এসপি-ডিসি ভাগ-বাটোয়ারা করছে। নির্বাচনের জন্য তারা সেই তালিকা সরকারকে সেগুলো দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকেও সেই দলগুলোর সঙ্গে সে ব্যাপারে সহায়তা করছে।’
উপদেষ্টা পরিষদে থেকে যারা এই কাজ করছে, তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে প্রধান উপদেষ্টাকে বলে এসেছেন বলে জানান নাহিদ।
কিন্তু এই তারা কারা, সে বিষয়ে নাহিদও মুখ খোলেননি। তবে এনসিপির নেতারা এর আগে বিভিন্ন উপদেষ্টার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের উপদেষ্টা রাখা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। যেমন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের নাম ধরে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ। এখন তাদের সঙ্গে আর কার কার নাম যুক্ত হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও মিলছে না।
এদিকে বিএনপির চাপের মুখে ইউনূস তার দুই সহকর্মী মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে পদত্যাগের পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে প্রথম আলো দাবি করেছে।
সংবাদপত্রটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কিন্তু তারা আরও সময় নিতে চেয়েছেন। মাহফুজ আলম আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে এখন পর্যন্ত আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তিনি সরকারে থাকতে চান। আসিফ মাহমুদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে পদত্যাগ করতে পারেন।
অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা চাপমুক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা।



