এক দিনে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের দুটি দৈনিকে শিরোনাম হয়ে এসেছে দুটি খবর; দুটিই বিলাসী জীবনের। একটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের বাড়ি বিলাসের; অন্যটি তার ক্ষমতাচ্যুতির পর সরকারে বসা উপদেষ্টাদের গাড়ি বিলাসের।
মঙ্গলবার প্রকাশিত দুটি খবরই বেশ আলোচনা তৈরি করেছে। দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকায় শেখ হাসিনার নানা সমালোচনা তো আগে থেকেই ছিল, তার ধারাবাহিকতা হিসাবেই বাড়ি বিলাসের খবরটি দেখছে পাঠকরা।
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ভর করে উপদেষ্টা হওয়া ব্যক্তিদের গাড়ি বিলাসের খবর দেখে অনেকে মন্তব্য করছে- ‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’।
‘হাসিনা-রেহানাদের ৪ বাগানবাড়ি, আছে ডুপ্লেক্স ভবন, শানবাঁধানো ঘাট, পুকুর’ শিরোনামের খবরটি ছাপা হয়েছে প্রথম আলোতে। এই দৈনিকের সম্পাদক মতিউর রহমান আওয়ামী লীগের শাসনামলে বেশ চাপে ছিলেন। ২০০৭ সালের ‘ওয়ান-ইলেভেনের’ কুশীলব হিসাবে তাকে দেখতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এবারের মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছের লোক হিসাবেও তাকে দেখেন অনেকে।
অন্যদিকে ‘সরকারি গাড়ি ব্যবহারে উপদেষ্টাদেরও অনিয়ম’ শিরোনামের খবরটি এসেছে সমকালে। এই দৈনিকটির মালিক ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন দীর্ঘদিন। শেষে গত বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হন তিনি। বিএনপিসহ অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়ে তিনি টিকতে পেরেছেন মোটে সাত মাস। সমকালের প্রকাশক আজাদ এখন পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্বও নিয়েছেন।
দুটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেই আবার দুই অনিয়মের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া নেওয়া হয়েছে একজনের। তিনি হলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান।
গাজীপুরে হাসিনা পরিবারের ৪ বাড়ি
ঢাকার পাশের জেলা গাজীপুরে শেখ হাসিনার পরিবারের চারটি বাগান বাড়ির খবর দিয়েছে প্রথম আলো। ডুপ্লেক্স বা দ্বিতল ভবন, শান বাঁধানো ঘাট ও পুকুর নিয়ে গড়ে তোলা এই বাড়িগুলোর খবর এতদিন অনেকেরই ছিল অজানা।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বাড়িগুলোর মধ্যে একটির মালিক শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং শেখ রেহানা, তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী। একটির মালিক শেখ রেহানার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিক। বাকি দুটির মালিক শেখ রেহানার দেবর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক।
নথিপত্র অনুযায়ী, চারটি বাগানবাড়ির দলিলাধীন জমির পরিমাণ ৮১৬ শতক বা ২৫ বিঘা। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জমির পরিমাণ এর অনেক বেশি। গড় মৌজা মূল্য বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ২৫ বিঘা জমির দাম প্রায় ৪৯ কোটি টাকা। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বর্তমান বাজার মূল্যে এই জমির দাম ১০০ কোটি টাকার কাছাকাছি।
শফিক সিদ্দিকের নামে থাকা বাড়িটির নাম টিউলিপ’স টেরিটরি। এটি গাজীপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কানাইয়া এলাকায়। শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকের মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের নামে এই বাড়ির নামকরণ। টিউলিপ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি। টিউলিপ’স টেরিটরিতে ডুপ্লেক্স বাড়ি ও কয়েকটি টিনের ঘর রয়েছে।
গাজীপুর শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মৌচাকের তেলিরচালা এলাকায় বাংলাদেশ স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পূর্ব পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘেঁষে রয়েছে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের একটি বাগানবাড়ি।
স্থানীয় ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালের দিকে স্থানীয় এক ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এ জমি লিখে দিয়েছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিক হয়েছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জমির কিছু অংশ সন্তানদের লিখে দেন। সেই সূত্রে মালিক হন সজীব ওয়াজেদ, সায়মা ওয়াজেদ, রাদওয়ান ও আজমিনা।
সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাগানবাড়িটির ভেতরে একটি দ্বিতল ভবন, শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর, সুইমিংপুল রয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন এই বাড়িতেও ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এখন বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
গাজীপুর মহানগরের ফাওকাল এলাকায় বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা ও টাকশাল নামে পরিচিত দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেডের পাশের বাগান বাড়িটির মালিক তারেক আহমেদ সিদ্দিক। এখানেও আছে ডুপ্লেক্স বাড়ি, শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর ও গাছপালা। এখানে ৫ আগস্ট ভাংচুর হয়েছিল।
গাজীপুর নগরীর বাঙ্গালগাছ এলাকায় রয়েছে বাংলোবাড়ি ‘বাগানবিলাস’। এটির মালিকও তারেক সিদ্দিক। এই বাড়িতেও রয়েছে একটি দোতলা ভবন, বিশাল পুকুর। একটি ‘ওয়াচ-টাওয়ার’ও রয়েছে সেখানে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় জমা দেওয়া হলফনামায় শেখ হাসিনা নিজের নামে সাড়ে ১৫ বিঘা কৃষিজমি দেখিয়েছিলেন, যা টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর ও রংপুরে অবস্থিত।
গাজীপুরের এই বাগান বাড়ির কোনো তথ্য হলফনামায় ছিল না। এই বাড়িগুলো কেনার পেছনে কোনো দুর্নীতি ছিল, এমন কিছু প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। তবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের কী কী সম্পদ আছে, তা খোঁজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, “শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ পৈতৃক সূত্রে ও লিখে দেওয়া সূত্রে জমি পেয়েছেন। শেখ হাসিনা হলফনামায় জমি দেখিয়েছেন। কিন্তু পরিবারের বাকি সদস্যসহ অন্যদের সম্পদ কী উপায়ে অর্জিত, তা নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার।”
উপদেষ্টাদের গাড়ি বিলাস
গত বছর শেখ হাসিনার সরকারের পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সরকারে উপদেষ্টা এখন ২২ জন।
তাদের সরকারি গাড়ি ব্যবহার নিয়ে সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শুরুটা হয় এভাবে- “মন্ত্রীদের সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহারের বদনাম বেশ পুরোনো। ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি গাড়ি নিয়ে মন্ত্রীদের ‘বাহাদুরি’ সে সময় কুড়িয়েছিল তিরস্কার। সবকিছু আমূল বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা এখন একই পথের পথিক। সরকারি গাড়ি ব্যবহারে তারাও নিয়ম-নীতির ধার ধারছেন না।”
প্রতিবেদনে বিধির কথা তুলে ধরে বলা হয়, উপদেষ্টাদের একটি করে সরকারি গাড়ি পাওয়ার কথা। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো কোনো উপদেষ্টা নিজের ও দপ্তরের নামে তিন থেকে চারটি সরকারি গাড়ি দখলে রেখেছেন। উপদেষ্টার পরিবারের সদস্যরা সেই গাড়ি ব্যবহার করছেন।
সমকাল খুঁজে বের করেছে, ২২ উপদেষ্টার মধ্যে আটজন ছাড়া বাকি সবাই একাধিক সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। একমাত্র বাণিজ্য উপদেষ্টা, ব্যবসায়ী সেখ বশিরউদ্দীন সরকারি কোনো গাড়িতেই চড়েন না। সরকারি কাজেও তিনি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন।
দায়িত্ব নেওয়ার পরই সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর (পরিবহন পুল) থেকে একটি করে টয়োটা হাইব্রিড ক্যামরি গাড়ি বরাদ্দ পান সব উপদেষ্টা। দৈনিক ১৮ লিটার জ্বালানি তেলের সমপরিমাণ টাকাও পাচ্ছেন তারা। তবে সমকালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কয়েকজন উপদেষ্টার পরিবারের সদস্য ব্যবহার করছেন বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার প্রকল্পের দামি গাড়ি। এসব বাড়তি গাড়ির পেছনে চালক, জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ গাড়িপ্রতি সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রতি মাসে গচ্চা যাচ্ছে প্রায় লাখ টাকা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম দুটি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। একটি তিনি ব্যবহার করেন, একটি তার পরিবারের কাজে ব্যবহার হয়। তার দপ্তরের নামে বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে আরও দুটি গাড়ি। সেগুলো তার পিএস ও পিআরও ব্যবহার করছেন।
এবিষয়ে ফারুক-ই-আজম সমকালের কাছে স্বীকারও করেন দুটি গাড়ি ব্যবহারের কথা। এভাবে ব্যবহার করা যায় কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি ওইভাবে দেখিনি। মন্ত্রণালয়ের সচিব দিয়েছেন, তাই ব্যবহার করছি।”
সরকারি ব্যয় সঙ্কোচনের কথা বলে আসা অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ ব্যবহার করছেন তিনটি গাড়ি। তিনি, তার পরিবারের সদস্য, পিএস মিলে ব্যবহার করছেন গাড়ি তিনটি।
অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা থেকে উপদেষ্টা বনে যাওয়া আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। তার পিএসও একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন।
উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ব্যবহার করছেন দুটি গাড়ি। তার পিএসও ব্যবহার করছেন আরেকটি গাড়ি। সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ ও ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেনও দুটি করে গাড়ি ব্যবহার করছেন। একটিতে তারা নিজেরা চড়ছেন, আরেকটিতে চড়ছেন পরিবারের সদস্যরা।
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারও দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। তিনি সমকালকে বলেন, “আমি খাদ্য অধিদপ্তরের একটা জিপ ব্যবহার করছি, আর পরিবহন পুলের গাড়িটা বাসায় থাকছে।” সাবেক এই সচিব বলেন, গাড়ির এমন ব্যবহার দীর্ঘকাল থেকে হয়ে আসছে।
এতদিনের চর্চা কোনো যুক্তি হতে পারে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা; কারণ হিসাবে তারা বলছেন, এমন চর্চা আর হবে না বলেই তো অভ্যুত্থান হয়েছে। ফলে উপদেষ্টারা যেভাবে গাড়ি ব্যবহার করছেন, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, “রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় এবং নিয়মের ব্যত্যয় যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা এই সরকারের জন্য জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকার এমন কিছু নজির স্থাপন করবে, যেটি পরে যে কোনো রাজনৈতিক সরকারের জন্য দৃষ্টান্ত হবে। আর যদি সেটি না করে একই ধারা অব্যাহত রাখে, তাহলে সেটি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুঃখজনক হবে।”