মুহাম্মদ ইউনূস গত বছর যখন সংবিধান সংস্কার বিষয়ক কমিশন গঠন করেন, তখন তার প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল আইনজীবী শাহদীন মালিকের নাম। কিন্তু তিনি রাজি হননি। তখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অধ্যাপক আলী রীয়াজকে সেই কমিশনের প্রধান করা হয়। পরে তাকে আরও ক্ষমতাবান করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি করে।
তারপর গত বছরের নভেম্বরে প্রায় অচেনা খলিলুর রহমানকে নিজের রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেনটেটিভ হিসাবে নিয়োগ দেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। এই খলিলও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। পরে তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মতো গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রঘেঁষা ইউনূসের প্রবাসী এই দুজনকে ‘আমদানি’ করে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন তুলেছিল। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ তো খলিলকে নিয়ে বলেই বসেন, কী কী পরিকল্পনা নিয়ে যে এসেছে ‘আল্লাহ মালুম’।
খলিল দায়িত্ব নিলেওে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথে অগ্রগতির কোনো দিশা মেলেনি। বরং মিয়ানমারের রাখাইনে বাংলাদেশ হয়ে ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপনের কথা তুলে তিনি যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি করেন।
আর আলী রীয়াজ সংস্কারের যে রূপরেখা দিয়েছেন, যার ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অধ্যাদেশ হয়েছে, তার মধ্যে আলোচনার বাইরের অনেক কিছুই তিনি যুক্ত করেছেন বলে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল থেকে সমালোচনা উঠেছে।
তবে সেসব ছাপিয়ে গেছে তাদের নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা। খলিলকে নিয়ে আগেই ছিল, এখন আলী রীয়াজকেও একই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
খলিলকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করার আগেই তার বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডের পুরনো সব খবর সামনে এনেছিলেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ।
তখনই উঠে আসে খলিলের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গোপন করা, হার্ভার্ডে পড়ার ভুয়া খবর, জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনে মোসাহেবীর মতো ঘটনা। দুই যুগ আগে ঢাকায় এক সরকারি নারী কর্মকর্তার সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং তার জেরে ওই নারীর খুন হওয়ার মতো বিষয়ও তখন সামনে চলে আসে।
খলিল ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮৩-৮৫ সময়কালে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালে তাকে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে বদলি করা হয়। তিনি ২০০১ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেন।
ফেইসবুকে ‘খলিল সমাচার’ শিরোনামে পোস্টে আরশাদ মাহমুদ সাংবাদিকতার সূত্রে খলিলকে গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে চেনার কথা জানান।
২০০১ সালে তাকে কেন হঠাৎ করে দেশে আনা হলো? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরশাদ জানতে পারেন, লতিফুর রহমানের ভায়রা ভাই তিনি। তাই দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে প্রধান উপদেষ্টার একান্ত সচিব বানানো হয়। কিন্তু পদটি যেহেতু যুগ্ম সচিব পর্যায়ের। সেজন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুটি পদোন্নতি দেওয়া হয় তাকে।
খলিল সম্পর্কে তার সাবেক এক সহকর্মীর বক্তব্য তুলে ধরে আরশাদ লেখেন, “তিনি এক সময় খলিলের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে চাকরি করতেন। আমি খলিল সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমেই বললেন সে প্রথম শ্রেণীর ধান্দাবাজ এবং নিজের আখের গোছানোর জন্য যা করা প্রয়োজন, সে সবই করে।”
২০০১ সালে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে নিয়োগ পাওয়ার মাস খানেকের মধ্যেই সচিবালয়ের এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে খলিলের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কথা লিখেছেন আরশাদ মাহমুদ।
ওই নারী কর্মকর্তা ছিলেন বিসিএস প্রশাসনের। তার স্বামীও ছিলেন বিসিএস কর্মকর্তা।
আরশাদ মাহমুদ লেখেন, “খলিল ওই মহিলাকে আরো নিবিড়ভাবে পাওয়ার জন্য নিউ ইয়র্ক মিশনে তাকে বদলির ব্যবস্থা করে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাসের পর খলিলও নিউ ইয়র্কে চলে যাবে।
“এতে ঘোর আপত্তি জানায় মহিলার স্বামী এবং এটা নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি হত। যখন মহিলা দৃঢ়ভাবে জানায় সে নিউ ইয়র্কে চলে যাবে, তখন তার স্বামীর সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে তার স্বামী মহিলাকে গুলি করে এবং নিজে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনার পরপরই খলিল দ্রুত দেশ থেকে পালিয়ে যায় এবং আমার জানামতে সে আর কখনও আসেনি।”
এই ঘটনা নিয়ে তখনকার সংবাদপত্রের প্রতিবেদনও পোস্টে যুক্ত করে দেন আরশাদ মাহমুদ।
খলিলকে নিয়ে সমালোচনা যখন স্তিমিত, তখন আলী রিয়াজকে নিয়ে মুখ খুললেন এক নারী। যিনি দাবি করেছেন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়াই শুধু নয়, গর্ভপাত ঘটাতেও তাকে বাধ্য করা হয়।
ওই নারীর বক্তব্য সম্বলিত ভিডিও এখন ফেইসবুকে ভাইরাল। তিনি অভিযোগ করেছেন, বর্তমানে তিনি প্রাণনাশের হুমকিতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ওই নারীর ভাষ্য অনুযায়ী, কবিতার সূত্র ধরে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফেইসবুকে আলী রীয়াজের সঙ্গে তার পরিচয়। আলী রীয়াজ নিজের একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার কথা বলে সম্পর্ক এগিয়ে নেন, বাড়ে সম্পর্কের গভীরতা।
ইউনূসের ডাকে ঢাকা আসার পর আলী রীয়াজ ওই নারীকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ডেকে নিয়েছিলেন বলে ওই নারীর দাবি। তিনি বলেন, তারা কয়েকদিন ওই হোটেলে একসঙ্গে ছিলেন। আলী রীয়াজ তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখান এবং খুব দ্রুত তাকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
শারীরিক সম্পর্কের একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিলেন জানিয়ে ওই নারী বলেন, “উনি বারবার আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে ওনার ভ্যাসেকটমি করানো আছে, তাই প্রোটেকশনের প্রয়োজন নেই। আমি ওনার মতো বড় মাপের মানুষকে বিশ্বাস করেছিলাম।”
গর্ভধারণের পর থেকে আলী রীয়াজ এড়িয়ে চলতে শুরু করেন দাবি করে তিনি বলেন, “এরপর দিলরুবা শারমিন নামে এক নারী তাকে ফোন করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে এবং আলী রীয়াজের বিপদের কথা বলে গর্ভপাতের জন্য চাপ দেন।”
ধানমণ্ডি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নিয়ে গর্ভপাত করানো হয় জানিয়ে ওই নারী বলেন, “গর্ভপাতের পর আলী রীয়াজ আমার সঙ্গে সবধরণের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। যোগাযোগের চেষ্টা করলে নেমে আসে মানসিক নির্যাতন ও হুমকি।
“পুলিশ আমাকে হুমকি দিচ্ছে। আমাকে তুলে নিয়ে গুম করার ভয় দেখানো হচ্ছে। আমি ভয়ে ফোন বন্ধ করে বোরখা পরে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। নিজের বাসাতেও থাকতে পারছি না।”
এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর আলী রীয়াজের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়েছে ইউনূসের প্রেস উইং। তাতে দাবি করা হয়েছে, আলী রীয়াজ ওই নারীকে চেনেনই না। এই ধরনের মিথ্যা বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচার করা হচ্ছে।
ওই নারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা েনওয়ার হুমকিও দিয়েছে ইউনূসের প্রেস উইং।
বিবৃতিতে বিষয়টি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তা চাপা থাকছে না। নানা গুঞ্জন আরও ডালপালা মেলছে।
এ সম্পর্কিত আরও প্রতিবেদন:



