এক খলিলে এত গোমর!

খলিলুর রহমান ওরফে ‘রজার রহমান’।
খলিলুর রহমান ওরফে ‘রজার রহমান’।

খলিলুর রহমানকে কয়েক মাস আগে দেশে কে চিনত?

“তিনি (খলিল) কয়েক মাস আগে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেন, তখন আমি প্রায় কিছুই জানতাম না তার সম্পর্কে,” একথাটি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের, যিনি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন এএফপিতে।

তার কাছেও অচেনা ছিলেন খলিল। এই কথাটি তিনি গত ৫ এপ্রিল এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছিলেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস গত নভেম্বরে খলিলকে তার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেনটেটিভ হিসাবে নিয়োগ দেন।

সেই খবর প্রচার হলে খলিল নামের ব্যক্তিটি চেনা হয়ে ওঠে সবার। এরপর প্রধান উপদেষ্টার থাইল্যান্ড সফরের আগে হঠাৎ করেই সংবাদ সম্মেলনে আসেন খলিল। তাতে বোঝা যায়, তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। তার পরের মাসেই তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়।

এখন তো ইউনূস প্রশাসনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে খলিলের নাম আলোচনায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সব বিষয়ে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেছেন তিনি।

বিমসটেক সম্মেলনে মুহাম্মদ ইউনূসের পাশেই বসেন খলিলুর রহমান।

গত ৫ এপ্রিলের ফেইসবুক পোস্টে খলিলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে প্রেস সচিব শফিকুল লেখেন, “অল্প ক’মাসের মধ্যেই তিনি আমাদের পররাষ্ট্র নীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রাণসঞ্চার করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবকে একটি স্মরণীয় রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইফতার সফরে নিয়ে যাওয়ার তার প্রচেষ্টা প্রধান উপদেষ্টার প্রশংসা কুড়িয়েছে। এমনকি অধ্যাপক ইউনূস তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছেন।”

তাতে বোঝা যায়, খলিল প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের খুবই আস্থাভাজন। 

তবে এই খলিলকে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের পাঠানো প্রতিনিধি হিসাবেই দেখেন কেউ কেউ। বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদের চোখে, “এই সুটটাইওয়ালা বসন্তের কোকিলরা সাধারণত প্যারাসুটের মাধ্যমে নাযিল হন এই দেশে।”

সব ঠিকই চলছিল কিন্তু গোল বাঁধালেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি গত শনিবার খুলনায় এক সভায় দাবি করেন, খলিল বিদেশি নাগরিক হওয়ায় দেশে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মতো স্পর্শকাতর পদে থাকতে পারেন না।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে উদ্দেশ করে সালাহ উদ্দিন বলেন, “একজন বিদেশি নাগরিককে আপনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করেছেন। সেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে আপনি বিদায় করুন।”

এরপর যেন খুলে গেল প্যান্ডোরার বাক্স। বেরিয়ে আসতে শুরু করল তার নানা কাণ্ড-কীর্তি। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গোপন করা তো রয়েছেই, তার সঙ্গে যোগ হল হার্ভার্ডে পড়ার ভুয়া খবর, জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনে মোসাহেবীর মতো ঘটনা। তার সঙ্গে উঠে এল দুই যুগ আগে ঢাকায় এক সরকারি নারী কর্মকর্তার সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং তার জেরে ওই নারীর খুন হওয়ার মতো বিষয়।

ফেইসবুকে নানাজন এখন খলিলের স্বরূপ উন্মোচন করছেন। সেই সঙ্গে ভারতের নর্থ ইস্ট নিউজেও এসেছে তার নানা কেলেঙ্কারির খবর।

খলিল কে?

খলিলকে গত ১৯ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী নিয়োগের খবরে প্রথম আলো তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিয়েছিল।

সেখানে বলা হয়েছিল, খলিলুর রহমান ১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পররাষ্ট্র) ক্যাডারে যোগ দেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও কূটনীতিতে এমএ এবং অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

খলিলুর রহমানের এই ছবিটি এক যুগ আগের।

১৯৮৩-৮৫ সময়কালে খলিলুর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালে তাকে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে বদলি করা হয়। ১৯৯১ সালে জেনেভায় জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনে (আঙ্কটাড) বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে জাতিসংঘ সচিবালয়ে যোগ দেন। তিনি ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেন।

খলিল বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, সেকথাও লেখা হয় নানা সংবাদমাধ্যমে।

উত্থান যেভাবে

খলিকে নিয়ে বেশ কয়েকটি পোস্ট দিয়েছেন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ, যেগুলোর শিরোনাম তিনি দিয়েছেন ‘খলিল সমাচার’।

খলিলের প্রশংসা করে প্রবাসী ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্যের ভিডিও থেকে তার সম্পর্কে পুরনো ঘটনাগুলো মনে পড়ে আরশাদ মাহমুদের।

তিনি লিখেছেন, “তার খুব প্রশংসা করে পিনাকী বলেছেন যে ডক্টর ইউনুস তার সাজেশন নিয়ে খলিল সাহেবকে নিয়োগ দিয়েছেন এবং সে কারণে তিনি খুবই খুশি।”

সাংবাদিকতা করার সূত্রে খলিলকে গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে চিনতেন আরশাদ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বপূর্ণ ফলের পর ১৯৭৯ সালের বিসিএসে খলিল প্রথম হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে যোগ দেন বলে আরশাদ জানান।

“কিছুদিন পর বোস্টন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। অর্থাৎ তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এসব কিছুই তার পজিটিভ দিক। কিন্তু এর অন্তরালে তার একটা কুৎসিত দিক আছে এবং সেটা জানানোর জন্যই আজকে আমার এই পোস্ট।”

খলিল নিউ ইয়র্কে স্থায়ী মিশনে কয়েক বছর কাজ করার পর ছুটি (লিয়েন) নিয়ে জাতিসংঘের একটি দপ্তরে যোগ দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন সেখানেই কাজ করেন তিনি।

এরপর হঠাৎ ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খলিলের প্রত্যাবর্তন ঘটে দেশে। তখন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান।

তাকে কেন হঠাৎ করে দেশে আনা হলো? সাংবাদিক হিসেবে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরশাদ জানতে পারেন, লতিফুর রহমানের ভায়রা ভাই তিনি। তাই দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে প্রধান উপদেষ্টার একান্ত সচিব বানানো হয়। কিন্তু পদটি যেহেতু যুগ্ম সচিব পর্যায়ের। সেজন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুটি পদোন্নতি দেওয়া হয় তাকে।

আরশাদ লিখেছেন, “বিষয়টি আমি লতিফুর রহমানের গোচরে আনি তার প্রথম প্রেস কনফারেন্সে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- আপনি একজন বিচারপতি, কী করে আপনি এরকম একটি বেআইনি কাজ করলেন?

“উত্তরে সেই সময়ের প্রধান উপদেষ্টা আমাকে বললেন যে সে অত্যন্ত মেধাবী এবং এ কারণেই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমি তাকে বললাম যে আমি খলিল সাহেবের মেধা নিয়ে কোন প্রশ্ন করিনি। আমি শুধু জানতে চেয়েছি যে কেন তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুটো প্রমোশন দিয়ে আপনার একান্ত সচিব বানানো হলো? এর কোন সদুত্তর তার কাছে ছিল না এবং তিনি আমতা আমতা করতে থাকেন।”

খলিল সম্পর্কে তার সাবেক এক সহকর্মীর বক্তব্য তুলে ধরে আরশাদ লিখেছেন, “তিনি এক সময় খলিলের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে চাকরি করতেন। আমি খলিল সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমেই বললেন সে প্রথম শ্রেণীর ধান্দাবাজ এবং নিজের আখের গোছানোর জন্য যা করা প্রয়োজন, সে সবই করে।”

নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনে খলিল যখন জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছিলেন, তখন আরশাদ মাহমুদ সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকার কূটনৈতিক প্রতিবেদক ছিলেন।

“তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলাম, নিউ ইয়র্ক মিশনে সে তৎকালীন স্থায়ী প্রতিনিধি জেনারেল এরশাদের শ্যালক মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। তাকে সকাল-বিকেল তোয়াজ করে তার আখের গুছিয়ে নিয়েছিল।

“এক সাবেক রাষ্ট্রদূত (যিনি সেই সময় খলিলের সঙ্গে নিউইয়র্ক মিশনে ছিলেন) আমাকে বললেন যে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর অফিসে আসার সময় খলিল এবং কয়েকজন তার সহকর্মী মিলে নিচে নেমে তাকে রিসিভ করতে যেত এবং অফিস থেকে যাওয়ার সময় আবার তার সঙ্গে নিচে যে তাকে গাড়িতে তুলে দিত। এটা ছিল তাদের প্রতিদিনের কাজ। এর মধ্যে খলিলের কাজ ছিল মহিউদ্দিন সাহেবের ব্যাগ ক্যারি করা।”

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে খলিলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আশা করা নিয়ে আরশাদ মাহমুদ বলেন, “আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে অন্তর্বর্তী সরকার থাকাকালীন এই সমস্যার কোন সমাধান হবে না। এবং এই সরকারের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে খলিল দেশ থেকে চলে যাবে।

“সে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী অধিবাসী। আর রোহিঙ্গা সমস্যা যেখানে ছিল, সেখানেই থাকবে। খলিলের নিয়োগে যে সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি সে হলো খলিল নিজে।”

নারী কেলেঙ্কারি

২০০১ সালে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে নিয়োগ পাওয়ার মাস খানেকের মধ্যেই সচিবালয়ের এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে খলিলের সম্পরেআক জড়িয়ে পড়ার কথা লিখেছেন আরশাদ মাহমুদ।

ওই নারী কর্মকর্তা ছিলেন বিসিএস প্রশাসনের। তার স্বামীও ছিলেন  বিসিএস কর্মকর্তা।

স্ত্রীর সঙ্গে রজার রহমান নামের খলিলুর রহমান।

আরশাদ মাহমুদ লিখেছেন, “খলিল ওই মহিলাকে আরো নিবিড়ভাবে পাওয়ার জন্য নিউ ইয়র্ক মিশনে তাকে বদলির ব্যবস্থা করে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাসের পর খলিলও নিউ ইয়র্কে চলে যাবে।

“এতে ঘোর আপত্তি জানায় মহিলার স্বামী এবং এটা নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি হত। যখন মহিলা দৃঢ়ভাবে জানায় সে নিউ ইয়র্কে চলে যাবে, তখন তার স্বামীর সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে তার স্বামী মহিলাকে গুলি করে এবং নিজে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনার পরপরই খলিল দ্রুত দেশ থেকে পালিয়ে যায় এবং আমার জানামতে সে আর কখনও আসেনি।”

এই ঘটনা নিয়ে তখনকার সংবাদপত্রের প্রতিবেদনও পোস্টে যুক্ত করে দিয়েছেন আরশাদ মাহমুদ।

তারপরও তাকে নিয়োগ করা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি লিখেছেন, “ড. ইউনুস কেন তাকে নিয়োগ দিল? তিনি কি খলিলের এই ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানতেন না? ধরে নেই যে তিনি হয়তো এটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। কিন্তু ড. ইউনূসের উচিত ছিল, এই ধরনের নিয়োগ দেওয়ার আগে ভালো করে খোঁজ-খবর করা।

“আপনি উপদেষ্টা পদমর্যাদায় একজনকে নিয়োগ দিচ্ছেন এবং এই দেশের ট্যাক্সপেয়াররা তার সমস্ত ভরণপোষণ বহন করবে। এর জবাবদিহি ড. ইউনূসকে একদিন অবশ্যই করতে হবে।”

রজারের মুখোশে খলিল

খলিলুর রহমানের বিদেশি নাগরিকত্ব রয়েছে বলে কথা আসার পর তাকে নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে ‘রজার রহমান’ নামে একটি ফেইসবুক আইডি পাওয়া যায়। ওই আইডির পোস্ট-ছবি, মন্তব্য, তার জবাব বিশ্লেষণ করে নর্থ ইস্ট নিউজ দেখিয়েছে, সেটি খলিলেরই আইডি।

দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত ওই আইডিতে গত ডিসেম্বর থেকে আর কোনো পোস্ট নেই। অর্থাৎ খলিল ইউনূসের প্রশাসনে দায়িত্ব পাওয়ার পর ফেইসবুকে নিষ্ক্রিয়।

নর্থ ইস্ট নিউজ দাবি করেছে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে টানা অবস্থান করে আসছিলেন খলিল। তিনি রজার রহমান নামে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নেন। এমনকি এই নামে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি চাকরিতেও নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন।

ফেইসবুক আইডির নাম রজার রহমান হলেও তার বিভিন্ন ছবিতে অনেকে মন্তব্য করার সময় ‘খলিল ভাই’ সম্বোধন করেন, আর তার উত্তরও দেন রজার নামের খলিল।

তার ছবিগুলো দেখেও নিশ্চিত হওয়া যায়, রজার রহমান নামের ফেইসবুক আইডিটি আসলে খলিলেরই।

সেই ফেইসবুক আইডিতে পরিবারের সদস্য হিসেবে শুধু সেলিন রহমান ডিমাত্তেও’র নাম রয়েছে। তিনি খলিলের বোন বলে জানায় নর্থ ইস্ট নিউজ। তিনিও নিউ ইয়র্কে থাকেন। খলিলের আরও ১৩ জন আত্মীয় নিউ ইয়র্কে থাকেন বলে খুঁজে পেয়েছে সংবাদপত্রটি।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে রজার রহমান বা খলিলের বেশ কয়েকটি ঠিকানার সন্ধানও পাওয়া গেছে, যেখানে তিনি বছরের পর বছর ধরে সপরিবারে বসবাস করে আসছেন।

রজার রহমান নামে ফেইসবুক আইডি চালান খলিলুর রহমান।

৭১ বছর বয়সী খলিল ১৯৯৮ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় ২৬ বছর ২৯, ব্রেটন রোড, স্কারসডেল এনওয়াই ১০৫৮৩ ঠিকানায় বসবাস করছেন বলে নর্থ ইস্ট নিউজের দাবি।

হার্ভার্ডে পড়ার ভুয়া দাবি

যুক্তরাষ্ট্রের নামি বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডের কেনেডি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন বলে খলিল দাবি করেন।

তবে এনিয়ে খোঁজ চালিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়ের ফেইসবুকে লিখেছেন, “শুইন‍্যেছিলাম ভদ্রলোক নাকি কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট হার্ভার্ডের থিকা এম এ ইন ল‍্য এন্ড ডিপ্লোমেসি কইরেছেন। কিন্তু কোথাও তো এমন কিছু খুঁজে পেলুম না। খলিলুর রহমান সাহেব, আপনি কি মিছা কথা কইছেন? “হার্ভার্ডের সার্টিফিকেটটা একটু দেখাইবেন পিলিজ? আমরা খুইজ‍্যে ওবামা আর তার বাপরেও বাইর কইরেছি, কিন্তু আপনারে পেলুম না কেনে? বি.দ্র. নামের ভ‍্যারিয়েশন পরিবর্তন করেও দেখেছি, যেমন Kalil, Kali, Kolil করেও দেখেছি, কিছ‍্যু নাই।”

হার্ভার্ডের অ্যালামনাই ডেটাবেজে খলিল নামে কেউ নেই জানিয়ে শায়ের লিখেছেন, হার্ভার্ডের সঙ্গে এমআইটি, টাফট ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসির চুক্তি রয়েছে। তার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা একটি অন্যটির কোনও কোর্স নিতে পারে। এর আওতায় হয়ত খলিল হার্ভার্ডে গুটিকয়েক ক্লাস করেছেন। তবে তিনি কোনোভাবেই হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট নন।

রজার রহমানের ফেইসবুক বন্ধুদের তালিকায় নুরুল ইসলাম ভূইয়া ছোটনের নাম দেখে সায়ের দাবি করেছেন, খলিল ‘ছোটন গ‍্যাং’ এর সদস‍্য।

এক সময়ের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ছোটন ২০০১-০৬ সালে বিএনপির কাণ্ডারি তারেক রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শফিক রেহমানের যায়যায়দিন পত্রিকা মূলত তিনিই চালাতেন। ফরহাদ মজহারের সঙ্গেও ছোটনের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

ছোটনের স্ত্রী ছিলেন অ্যাকশন এইডের আবাসিক পরিচালক নাসরিন হক। তিনি নিজের বাড়িতে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন। নাসরিন হকের বোন শিরীন হক বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান। তার স্বামী প্রয়াত জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ‘ছোটন গ্যাং’র বড় প্রভাব রয়েছে বলে দাবি করে আসছেন জুলকারনাইন শায়ের।

খলিলের অস্বীকারেও ফাঁক

বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললে তার প্রতিক্রিয়া সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসকে জানান খলিল, কিন্তু সেখানেও তিনি কৌশলে তার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের বিষয়টি এড়িয়ে যান।

সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের কারও দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ থাকলেও তা গ্রহণ করলে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে থাকার যোগ্যতা হারাতে হয়।

যেমন কেউ বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলে রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যের পদ নেওয়ার যোগ্যতা হারান।

একালের খলিলুর রহমান।

খলিলুর বর্তমানে মন্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। ফলে তার এই পদে থাকার যোগ্যতা নেই বলে দাবি উঠেছে।

খলিল বাসসকে বলেন, “আমি একজন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে আমার পূর্ণাঙ্গ অধিকার ভোগ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।”

যারা তার বিদেশি নাগরিকত্ব থাকার দাবি তুলেছে, তাদেরই তা প্রমাণের আহ্বান জানান খলিল।

তিনি বলেন, “এই অভিযোগ প্রমাণের দায়ভার অভিযোগকারীর ওপর বর্তায় এবং প্রয়োজনে তা আদালতে প্রমাণ করতে হবে।”

এই বিবৃতিতে খলিল একবারের জন্যও বলেননি যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন, যা সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়েরের চোখে ধরা পড়েছে।

তিনি বলেছেন, “আপনার জন্য এর চেয়ে সহজ এটা প্রমাণ করা যে আপনি বাংলাদেশের নাগরিক, অন্য কোনো দেশের নাগরিক নন। সেটাই প্রমাণ করে দেখিয়ে দিন না যে সবাই গুজব ছড়াচ্ছে। চেষ্টা করুন না।”

আরও পড়ুন