তাহলে কি একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের পথ খুললো? আইন সংশোধনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়া করানোর আগে এমন প্রশ্নই ঘুরেফিরে আসছে।
এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদন পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈঠকে, আর তা শনিবার রাতেই অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনে রূপান্তর করা হয়েছে।
আইনের এই সংশোধনের পর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের বিষয়টিও এখন নতুন করে আলোচনায়।
কারণ এখন ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকেও শাস্তি দিতে পারবে।
সংশোধিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এই আইন বা প্রযোজ্য অন্যান্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, যদি ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয় যে কোনো সংগঠন এ আইনের ৩ ধারা উপধারা (২)-এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেছে, আদেশ দিয়েছে, চেষ্টা করেছে, সহায়তা করেছে, উসকানি দিয়েছে, মদদ দিয়েছে, ষড়যন্ত্র করেছে, সহযোগিতা করেছে অথবা অন্য যেকোনোভাবে সেই অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছে, তাহলে ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা থাকবে সংগঠনটির কার্যক্রম স্থগিত বা নিষিদ্ধ করার, সংগঠনের নিষিদ্ধ ঘোষণার, এর নিবন্ধন বা লাইসেন্স স্থগিত অথবা বাতিল করার এবং এর সম্পত্তি জব্দ করার।
আইনে সংগঠন বলতে যেকোনো রাজনৈতিক দলকেও বোঝাবে বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। পাশাপাশি দলের অধীন, সম্পর্কিত বা সংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠন অথবা গোষ্ঠীকে বোঝাবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীমকে উদ্ধৃত করে প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে লিখেছে, সংশোধনীর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সংগঠনের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা রাখা হয়েছে। প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) মনে করে, এটি একটি যথোপযোগী উদ্যোগ। তিনি বলেন, যদিও বাংলাদেশে প্রচলিত অন্যান্য আইনেও সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বা সংগঠনের বিরুদ্ধে শাস্তি নেওয়ার বিধান আছে। তারপরও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো একটি আন্তর্জাতিক মানের আইন বা ট্রাইব্যুনালে সংগঠন বা ব্যক্তির বিচার হলে তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
মূলত এই সংশোধনীর দাবিতেই ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সূত্রপাত, যেখানে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের দাবিতে লাখো ছাত্রজনতা জড়ো হয়েছিলেন। যদিও দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেও আইনটি সংশোধনের ঝুঁকি এড়িয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এর এক যুগ পর যখন আইনটি সংশোধন করা হলো তখন কাঠগড়ায় উল্টো সেই আওয়ামী লীগই।
আওয়ামী লীগকে কাঠগড়ায় দাাঁড়া করাতে আইনের সংশোধন করা হলেও এখন প্রশ্ন উঠেছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করা দল জামায়াতে ইসলামীর বিচারের প্রক্রিয়াটি কীভাবে চলবে!
নিবন্ধন ও জামায়াতের বিচার নিয়ে প্রশ্ন শিরোনামের এক প্রতিবেদনে ডয়েচে ভেলে কথা বলেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দল হিসেবে আত্ম প্রকাশ করা নিবন্ধনহীন জাতীয় নাগরিক কমিটি বা এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিনকে উদ্ধৃত করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে মনিরা শারমিন বলেন, “আমার দলের অবস্থান আমি জানি না। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, বাংলাদেশে যারা বা যে দল গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত তাদের সবার বিচার চাই। আইনের সংশোধনের মাধ্যমে দলের বিচারের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে অন্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের পথ সুগম হয়েছে। জামায়াতকেও বিচারের আওতায় আনা উচিত। আমরা ১৯৭১ এবং ২৪ কে আলাদা করে দেখি না।”
শনিবার রাতেই এ বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন জুলাই আন্দোলনের ‘মাস্টার মাইন্ড’ হিসেবে যাকে ভাবা হয় সেই মাহফুজ আলম। নিজের ভেরিফাইড ফেইসবুকে এ প্রসঙ্গে কথা বলে এখন তিনি ‘নিজেদের পক্ষের শক্তি’র তোপের মুখে পড়েছেন।
জামায়াতের নাম উল্লেখ না করলেও তিনি ওই পোস্টে লিখেছিলেন, “‘৭১ এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান এদেশে গণহত্যা চলিয়েছে। ইনিয়ে বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে বয়ান উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে স্যাবোট্যাজ করা বন্ধ করতে হবে। সাফ দিলে আসতে হবে।”
শুরুতে যেকোনো দলের নিষিদ্ধের বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার না করলেও আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর বিএনপিও দৃশ্যত অবস্থান বদলেছে, দলের শীর্ষ নেতারা এখন বলছেন তারাও চেয়ে আসছিলেন আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা।
আওয়ামী লীগের বিচার প্রশ্নে নীরব থাকলেও এবার জামায়াতের বিচারের বিষয়েও খোলামেলা কথা বলছেন দলটির নেতারা।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স এ প্রসঙ্গে বলেন, “একাত্তরে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদেরও আমরা বিচার দাবি করছি। জামায়াত যদি সেই অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তাহলে তো কিছু করার নেই। আমরা আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে বলেছিলাম। এখনো তাই বলছি।”
“জামায়াতের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গণহত্যার অভিযোগ, সেটা তো এখনো বিচারের আওতায় আসেনি। এটা গত ৫২-৫৪ বছর ধরে অমিমাংসিত থেকে গেছে। এটা প্রতিশোধ, প্রতিহিংসার বিষয় নয়। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার বিচারের বিষয় কখনো শেষ হবে না। সুতরাং বিচারের এই প্রশ্ন আসবেই,” বলেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।
আওয়ামী লীগের নিবন্ধনের কী হবে?
আওয়ামী লীগ যে এবারই প্রথমবারের মতো নিষিদ্ধ হলো বা দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো বিষয়টি তেমন নয়। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালো রাতে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আখ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান, ৫৪ বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো অন্তর্বর্তী শাসক ইউনূসের জমানায়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে রাখা হলেও সেসময়ও দলটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। দেশে না থাকায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া তার মেয়ে শেখ হাসিনা প্রায় ছয় বছর পর নির্বাসিত জীবনের ইতি টেনে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন। মূলত তার ফিরে আসার মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক জীবনে নতুন এক অধ্যায় সূচিত হয়েছিল।
এরপর থেকে চারবার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর আগে টানা ১৫ বছরের বেশি সময় শাসনভার সামলেছে দলটি।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর দলটির নিবন্ধন থাকা বা না থাকা নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সরকারি আদেশ পাওয়ার পর তারা দলটির নিবন্ধনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
“সরকারি গেজেট হলে আমরা দেখব আইন কী বলে। আইন দেখে সিদ্ধান্ত হবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন থাকবে কী না। আমাদের তো সরকারের আদেশ মানতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
কেমন হবে আগামীর রাজনীতি
বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, অনেকের ধারণা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বেশী সোচ্চার দেখা যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীকে। দলটিকে নিষিদ্ধের দাবিতে যে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে, তাতেও উগ্রপন্থী হিসেবে সমালোচিত অনেককেও যোগ দিতে দেখা গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পরপরই এই গোষ্ঠীগুলো সামনে উঠে এসেছে। এখন আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে নিষিদ্ধ থাকলে ধর্ম নিরপেক্ষতা, সংস্কৃতি ও নারীর অগ্রযাত্রার মতো বিষয়গুলো সংকটে পড়বে বলে অনেকে মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন এ বিষয়ে বলেন, “যে কোন পরিস্থিতিতেই কোন দল নিষেধাজ্ঞায় পড়লে সে আরও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগকে বিনাশ করতে গিয়ে যদি ধর্মীয় উন্মাদনাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়, তার পরিণতি ভালো হবে না। দক্ষিণ এশিয়ায় এমন উদাহরণ কিন্তু আছে। এই উন্মাদনার বিরুদ্ধে বিএনপির পদক্ষেপ কেমন হয়, তার ওপরও দেশের রাজনৈতিক চিত্র অনেকটা নির্ভর করবে।”
তার মতে, এবার যা হয়েছে তা শুধু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয় নয় বরং এর সাথে একটি গোষ্ঠীর ক্ষমতার চর্চার যে বহি:প্রকাশ দেখা গেছে। সেটি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য সুখকর হবে না বলে মনে করেন তিনি।
এ সংক্রান্ত আরও খবর:
ইয়াহিয়ার ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী দল’ ইউনূসের জমানায় কাঠগড়ায়
বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ
সন্ত্রাসবিরোধী অধ্যাদেশে যুক্ত হলো ‘সত্তার কার্যক্রম’ নিষিদ্ধের বিধান