চীনের স্টার্টআপ ডিপসিকের কম খরচে তৈরি এআই মডেলের সাফল্য ও জনপ্রিয়তা মার্কিন এআই শিল্পে তৈরি করেছে আলোড়ন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ স্থানীয় প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর প্রশংসাও কুড়িয়ে নিয়েছে ডিপসিক উদ্ভাবিত ‘আর-ওয়ান’ মডেল।
অবশ্য তারা এও বলছেন, তাদের বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রযুক্তিকে ‘হার মানানো’ এতটা সহজ নয়।
ডিপসিকের নতুন মডেলের ঘোষণায় সোমবার পুঁজিবাজারে প্রযুক্তি খাতের শেয়ার ছেড়ে দেওয়ার হিড়িক তোলে এবং মুহূর্তের মধ্যে তাদের বিনামূল্যের এআই অ্যাসিস্টেন্ট ‘ওপেনএআই’ এর চ্যাটজিপিটিকে পেছনে ফেলে অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে শীর্ষস্থান দখল করে নেয়।
তারা দাবি করেছে যে, এনভিডিয়া’র কম ক্ষমতাসম্পন্ন ‘এইচ-৮০০’ প্রসেসর চিপ ব্যবহার করে মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলারেরও কম খরচে এই মডেলটিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
মার্কিন পুঁজিবাজারে প্রতিযোগিতার শঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা হুড়োহুড়ি করে ছেড়ে দিয়েছেন এআই সংশ্লিষ্ট বড় বড় প্রযুক্তি খাতের শেয়ার। আর তাতে হু হু করে কমেছে সেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ ডিপসিকের কার্যকরী টিম এবং আপ-টু-ডেট গবেষণার প্রশংসা করলেও তাদের এই উন্নয়নকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না শীর্ষ এআই ল্যাবের সঙ্গে যুক্তরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। একজন বলেছেন, তাদের রেকর্ডে কথা বলার অনুমতি নেই।
অবশ্য ওপেনএআই এর সিইও স্যাম অল্টম্যান এক্স এর হ্যান্ডলে লিখেছেন, ডিপসিকের আরওয়ান মডেলটি “নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার মডেল, বিশেষ করে এর দামের তুলনায় যা তারা দিতে পারছে তা বিস্ময়কর।”
এনভিডিয়া একটি বিবৃতিতে বলেছে, ডিপসিকের সাফল্য প্রমাণ করে যে তাদের আরও চিপের প্রয়োজন রয়েছে।
সফটওয়্যার কোম্পানি স্নোফ্লেইক সোমবার ডিপসিকের মডেলকে তাদের নিজেদের এআই মডেলে যুক্ত করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।
কোম্পানির প্রোডাক্ট বিভাগের কার্যনির্বাহী উপ-সভাপতি ক্রিশ্চিয়ান ক্লেইনারম্যান বলেছেন, তাদের কর্মীরাও ডিপসিকের মডেলকে ‘অসাধারণ’ বলে মানছেন। চীনের তৈরি এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাব্য ঝুঁকি সত্ত্বেও গ্রাহকদের কথা মাথায় রেখে এই মডেল নিজেদের এআই মডেলে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে যতক্ষণ গ্রাহকদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার থাকবে, ততক্ষণ এই মডেলকে সমর্থন দিতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।”
এদিকে, মার্কিন এআই ডেভেলপাররা ডিপসিকের ভি-থ্রি মডেল বিশ্লেষণে তোড়জোড় শুরু করেছেন। ডিসেম্বরে ডিপসিক ওই মডেলের সঙ্গে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিল, যা তাদের জনপ্রিয় অ্যাপটির ভিত্তি।
অবশ্য এটি তৈরিতে মোট খরচের মতো অনেক প্রশ্নের উত্তর ওই নথিতে দেওয়া হয়নি।
একটি সূত্র বলেছে, চীন এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক এআই মডেলের তুলনায় মাত্র ছয় মাস পিছিয়ে রয়েছে, যা আগে ছিল ১৮ মাস।
তবে ডিপসিকের বিনামূল্যে পরিষেবা দেওয়ার কৌশল এতটাই আগ্রহ তৈরি করেছে যে কোম্পানিটি চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত চিপ সংকটের মুখোমুখি হতে পারে বলে ওই সূত্রের ধারণা।
ডিপসিকের মাত্র ছয় মিলিয়ন ডলারের এই ‘খুচরা’ বিনিয়োগ মার্কিন ক্লাউড কোম্পানিগুলোর এআই অবকাঠামোর উন্নয়নে ব্যয় করা বিনিয়োগের তুলনায় খুব সামান্য।
গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এই খরচ শুধুমাত্র চূড়ান্ত ট্রেনিং দেওয়ার জন্য চিপ ব্যবহারের খরচ, প্রকল্পের সম্পূর্ণ ব্যয় নয়।
এআই ল্যাবের নির্বাহীরা রয়টার্সকে বলেছেন, মোট খরচের ক্ষেত্রে এই প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় ‘হিমশৈলের চূড়ামাত্র’। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রশিক্ষণ বা ‘ট্রেনিং রান’ নকশা করার পদ্ধতি নির্ধারণের খরচ বহুগুণ বেশি হতে পারে।
নথিতে বলা হয়েছে, ভি-থ্রি’র ‘ট্রেনিং রানে’ এনভিডিয়া’র ২ হাজার ৪৮টি এইচ৮০০ চিপ ব্যবহার করে করা হয়েছে, যা ২০২২ সালে প্রকাশিত মার্কিন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা মেনে তৈরি করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা রয়টার্সকে বলেছেন, এই নীতিমালা চীনের এআই অগ্রগতিকে সামান্যই ধীর করবে।
এআই ল্যাবের সূত্র বলেছে, ডেভেলপমেন্টের প্রাথমিক পর্যায়ে আরও বেশি সংখ্যক চিপ ব্যবহার করা হতে পারে।
এমন বিনিয়োগের খরচ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হতে পারে বলে ওই সূত্রের দাবি।
কোনো কোনো মার্কিন এআই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা ডিপসিকের মডেলগুলো ওপেন সোর্স হিসেবে চালু করার সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন, যার অর্থ অন্য কোম্পানি বা ব্যক্তিরা এগুলো স্বাধীনভাবে ব্যবহার বা পরিবর্তন করতে পারবে।
ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট মার্ক অ্যান্ড্রিসেন রোববার এক্সের হ্যান্ডলে লিখেছেন, “ওপেন সোর্স হিসেবে ডিপসিক আর-ওয়ান আমার দেখা সবচেয়ে বিস্ময়কর উদ্ভাবনগুলোর একটি, এটি বিশ্বের জন্য একটি দারুণ উপহার।”
প্রযুক্তি পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ডিপসিকের মডেলগুলোর এই স্বীকৃতি প্রমাণ করে চ্যাটজিপিটি’র মতো ব্যয়বহুল ও নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তির বিকল্প হিসেবে চীনের স্টার্টআপের মডেল বেশ কার্যকর হবে।
ওয়াল স্ট্রিটের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানিগুলো গত কয়েক বছরে বিপুল বিনিয়োগ করেছে এই আশায় যে কেবল তাদেরই এআই প্রযুক্তির উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ এবং কম্পিউটিং সক্ষমতা রয়েছে। মার্কিন টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর ত্রৈমাসিক আয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু হলে তাদের হয়তো আরও কঠিন বাস্তবতা সামলাতে হতে পারে।
এ সংক্রান্ত আরও খবর: