যেমনটি ভাবা হচ্ছিল তেমনটি মোটেও হলো না। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে সমর সহায়তার বিপরীতে ইউক্রেনের খনিজে ভাগ বসাতে চেয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সবকিছু ঠিকঠাক এগোচ্ছিল; ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সবুজ সংকেত দিয়েই গিয়েছিলেন হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে। তবে শেষটা ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ এর স্রষ্টার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মোটেও যায়নি। কথার লড়াই গিয়ে গড়ায় বিতণ্ডায়।
শুক্রবার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে বৈঠক উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। হয়নি ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক দুই রাষ্ট্রনেতার চুক্তি সই।
রাশিয়ার সঙ্গে তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধে ট্রাম্পের পূর্বসূরি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে সাড়ে তিনশ’ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও অর্থসহায়তা পেয়েছে ইউক্রেন। অবশ্য ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পরে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। শুধু জেলেনস্কির সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি ট্রাম্প, সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন সহায়তার বিপরীতে খনিজের ভাগ দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
সাংবাদিকদের সামনেই জেলেনস্কিকে একের পর আক্রমণ করে বক্তব্য দেন ট্রাম্প। জেলেনস্কি ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন’ বলে অভিযোগ করেন ট্রাম্প।
তিনি বলেন, “আপনার দেশের মানুষ খুবই সাহসী; কিন্ত আপনাকে হয় (রাশিয়ার সঙ্গে) একটি চুক্তি করতে হবে নইলে আমরা আর আপনাদের সঙ্গে নেই। আর আমরা যদি না থাকি তাহলে আপনাকে একা লড়তে হবে।”
ট্রাম্প ও জেলেনস্কির কথাবার্তা এক পর্যায়ে বিতণ্ডার পর্যায়ে পৌঁছে। ‘জেলেনস্কি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন’ দাবি করে ট্রাম্প বলেন, “মানুষ মারা পড়ছে। যুদ্ধের জন্য সেনার সংখ্যাও কমছে ক্রমশ। আপনার হাতে কার্ড (বিকল্প) নেই। একবার আমরা চুক্তি সই করলে আপনি ভালো অবস্থানে চলে যাবেন। কিন্ত আপনাকে আদৌ কৃতজ্ঞ মনে হচ্ছে না। সত্যি কথা বলতে কী এটা ভালো কোনো বিষয় নয়।”
ট্রাম্প জেলেনস্কিকে বলেন, যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করতে চাইলে ইউক্রেনকে ছাড় দিতে হবে।
তিনি বলেন, “ছাড় দেওয়া ছাড়া আপনি কোনো চুক্তি করতে পারবেন না। তাই এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তাকে (জেলেনস্কি) কিছু ছাড় দিতে হবে। কিন্তু আশা করি, বড় কোনো ছাড় দিতে হবে না যেমনটা লোকে বলে বেড়াচ্ছে।”
ট্রাম্পের এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে জেলেনস্কি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নাম উল্লেখ করে বলেন, একজন খুনিকে কোনো ছাড় দেওয়া উচিত নয়। এসময় পুতিনের বিষয়ে ট্রাম্পের নমনীয় অবস্থানের সমালোচনাও করতে ছাড়েননি জেলেনস্কি। একজন খুনির সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা না করার জন্য ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
কথার এক পর্যায়ে জেলেনস্কির সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সও। ওভাল অফিসে বসে বিতণ্ডায় জড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জেলেনস্কি অসম্মান করেছেন মন্তব্য করে ভ্যান্স বলেন, “আপনি একবারও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন না।” এসময় মাথা নেড়ে ভ্যান্সের কথায় সায় দেন ট্রাম্প। এ সময় উচ্চকণ্ঠে জেলেনস্কিকে বলতে শোনা যায়, “বহুবার বলেছি, আমেরিকার জনগণকে ধন্যবাদ।”
রীতি অনুযায়ী হোয়াইট হাউসে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে বৈঠকের পর একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন হয়ে থাকে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জেলেনস্কির উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর সংবাদ সম্মেলনটি বাতিল করার কথা জানানো হয়।
এ সময় জেলেনস্কি ও তার সফরসঙ্গীদের হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে দেখা যায়।
এদিকে, জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক শেষে ট্রাম্প তার মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশালে দেওয়া একে পোস্টে লিখেছেন, জেলেনস্কি ‘যুক্তরাষ্ট্র ও এ দেশের শ্রদ্ধার জায়গা ওভাল অফিসকে (হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয়) অসম্মান’ করেছেন।
তিনি বলেন, “যেদিন তিনি (জেলেনস্কি) শান্তির জন্য প্রস্তুত হবেন, আবার (হোয়াইট হাউসে) ফিরে আসতে পারেন “
ওভাল অফিসের আবহ যেমন ছিল
বিবিসি ওই বৈঠকের আবহ তুলে ধরে জানিয়েছে, হোয়াইট হাউসে আর দশজন রাষ্ট্রীয় অতিথির জন্য যেরকম সৌহার্দ্যপূর্ণ রুটিন রাখা হয়, সেরকম সৌহার্দ্যপূর্ণ আবহে দিনটি শুরু হয়েছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওয়েস্ট উইংয়ের দরজায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে স্বাগত জানান এবং কুশল বিনিমেয়ের পাশাপাশি বিনয়ের সঙ্গে করমর্দন করেন তারা।
শুরুতে প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতা শেষে এবং প্রায় আধা ঘণ্টা স্বাভাবিক আলোচনা চলে। এ সময় জেলেনস্কি ট্রাম্পকে ইউক্রেনের বক্সার ওলেকসান্দার ওসিকের চ্যাম্পিয়নশিপ বেল্ট উপহার দিয়েছিলেন। উপহার পেয়ে ট্রাম্প জেলেনস্কির পোশাকের প্রশংসা করতে থাকেন।
অবশ্য কয়েক মিনিট পরেই যা ঘটল তা রীতিমতো অভাবনীয়। আর সবকিছুই হচ্ছিল বিশ্বের টিভি ক্যামেরার সামনেই, যা রীতিমতো বিরল ঘটনা।
কথা প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য মার্কিন সমর্থনের প্রতি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ না হওয়ার অভিযোগ তোলেন।
ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স জেলেনস্কিকে যখন বলেন যে কূটনীতির মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হবে, তখন উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়।
একটু উঁচু গলায় জেলনস্কি জানতে চান, কী ধরনের কূটনীতি?
তখন ট্রাম্প বলে ওঠেন, “আপনি অনেক কথা বলে ফেলেলেন। আপনি এটা জিতছেন না।”
“আপনাকে কৃতজ্ঞ হতে হবে। আপনার কাছে আর কোনো কার্ড নেই,” যোগ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
“আমি কার্ড খেলছি না,” জবাব দেন জেলেনস্কি।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমি খুবই সিরিয়াসলি বলছি, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। আমি একটি যুদ্ধের প্রেসিডেন্ট।”
এ পর্যায়ে ট্রাম্প বলেন, “আপনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন এবং আপনি যা করছেন তা দেশটির প্রতি, এই দেশের প্রতি, যারা আপনাকে অনেক লোকের চেয়ে অনেক বেশি সমর্থন দিয়েছে যা তাদের বলা উচিত ছিল।”
ভ্যান্স তখন যোগ করেন: “এই পুরো বৈঠকে একবারও ‘ধন্যবাদ’ বলেছেন? না।”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যখন জেলেনস্কি তর্কে লিপ্ত তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূতকে মাথায় হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়।
সাংবাদিকরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এরকম ঘটনা আর ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।
“হোয়াইট হাউজে এমন দৃশ্য কল্পনাতীত,” বিবিসির প্রতিনিধিকে বলেন একজন সাংবাদিক।