বগুড়ায় হেফাজতে আবারও আ. লীগ নেতার মৃত্যু, ওঠেছে প্রশ্ন, সন্দেহ

Bogra Central Jail

আওয়ামী লীগ নেতাদের জন্য বগুড়া কারাগার ‘মৃত্যুকূপ’ হয়ে ওঠেছে। সুস্থ ব্যক্তিদের কারাগারটিতে নিয়ে যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে লাশ। সবার ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ ‘হৃদরোগ’।

গত চার মাসে এই কারাগারে হেফাজতে থাকা পাঁচজন আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু হয়েছে। ১১ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৮ দিনে চার জন আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু হয়েছিল।

সর্বশেষ মঙ্গলবার বগুড়া জেলা কারাগারে বন্দী গাবতলী উপজেলার দক্ষিণ পাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এমদাদুল হক ওরফে ভট্টু (৫২) মারা গেছেন। যথারীতি হৃদরোগে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।

‘হার্ট অ্যাটাক কিংবা অন্য অসুস্থতায়’ এদের মৃত্যু হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও নিহতদের একজনের সন্তান বলেছেন তার বাবা ‘কখনোই হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন না’ এবং কারাগারে যখন তারা সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন তখনও কোন অসুস্থতার কথা তার বাবা তাদের জানাননি।

কারাগারে বন্দী অবস্থায় মারা যাওয়া আরও দুজনের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও ভয়ে তারা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

যদিও কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, আওয়ামী লীগের এসব নেতারা আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।

অন্য বন্দীরা হৃদরোগে আক্রান্ত না হলেও শুধু আওয়ামী লীগের নেতারা কেন আক্রান্ত হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছে কারা কর্তৃপক্ষ।

সমালোচনার মুখে এসব মৃত্যুর ঘটনায় জেলা প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও কার্যক্রম নেই।

মঙ্গলবার গাবতলী উপজেলার দক্ষিণ পাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এমদাদুল হক ওরফে ভট্টুর মৃত্যু সম্পর্কে কারাগারের জেলার সৈয়দ শাহ শরীফ জানান, এমদাদুল হকের আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদযন্ত্রে জটিলতা ছিল। ভোরের দিকে অসুস্থতা বোধ করলে তাৎক্ষণিক তাকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।

যদিও তার মৃত্যুর সঠিক কারণ চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করতে পারেননি বলেও জানান কারাগারের জেলার।

জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, “বগুড়া কারা কর্তৃপক্ষ ভোরের দিকে এমদাদুল হক নামের একজনকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসে। সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।”

এমদাদুলের স্ত্রী নাজমা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, “রাজনীতি করার কারণে বিস্ফোরক ও ভাঙচুরের মামলায় তার স্বামীকে ২৬ ফেব্রুয়ারি গাবতলী মডেল থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি মাত্র ১২ দিন কারাগারে বন্দী ছিলেন।”

এর আগে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর কারাগারে বন্দী অবস্থায় মারা যান জেলার গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল মতিন ওরফে মিঠু (৬৫)।

বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহাদত আলম ওরফে ঝুনু (৫৭) গত ২৬ নভেম্বর মারা যান।

২৫ নভেম্বর মারা যান শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুল লতিফ (৬৭)।

এ ছাড়া ১১ নভেম্বর কারাবন্দী অবস্থায় মারা যান বগুড়া পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম ওরফে রতন (৫৮)।

কারাগারে বন্দী বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদত আলম ঝুনুর ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিল তার পরিবার।

ঝুনুর ছেলে রিয়াদ উল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “আমার বাবার কখনোই হৃদরোগ ছিলো না। আমরা কারাগারে যখন সাক্ষাত করেছি তখনো এমন কোন অসুস্থতার কথা তিনি বলেন নি”।

শাহাদত আলম ঝুনু রাজনীতির পাশাপাশি বগুড়ার একটি সুপরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ছিলেন। আশির দশকে ছাত্ররাজনীতি করার সময় থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ঝুনু গ্রেপ্তারের হওয়ার আগ মুহূর্তেও আমার সাথে ফোনে কথা বলেছেন। সুস্থ সবল ও সজ্জন মানুষটা আটক হয়ে কারাগারে গেল। সরকার তার লাশ উপহার দিলো।”

কারাগারে মৃত আওয়ামী লীগের নেতারা সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না বলছেন কারাগারে হোক আর পুলিশ হেফাজতে হোক- একজন আটক ব্যক্তি যখন মারা যান, তখন তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে। আবার কারা কর্তৃপক্ষ যদি বলেন তারা আগেই গুরুতর অসুস্থ ছিলো তাহলে তো তাদের আগে থেকেই হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু এসব ঘটনায় কী সেটি করা হয়েছে?”

কারাগারে বন্দী আওয়ামী লীগ নেতাদের মৃত্যুর ঘটনায় জেলা প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে এ কমিটির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। এর অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

বগুড়া জেলা কারাগারের জেলার সৈয়দ শাহ শরীফ বলেন, “এর আগে চার নেতার মৃত্যুতে গঠিত তদন্ত কমিটির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সিভিল সার্জন বদলি হওয়ায় এ কার্যক্রম কিছুটা থমকে গেছে।”

বগুড়া জেলা কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা ৭৭০ জন। বর্তমানে সেখানে বন্দীর সংখ্যা ১ হাজার ৬০৩।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads