দিন যত গড়াচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব ততই বাড়ছে। সর্বশেষ সংবিধান নিয়ে দুই পক্ষের মতভেদ আবার প্রকাশ্য হলো। বর্তমান সংবিধানকে ‘মুজিববাদী’ আখ্যায়িত করে যখন তা বাতিলের দাবি জুলাই আন্দোলনের ছাত্রনেতারা তুললেন, তখন তার বিরোধিতা এল আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ দল বিএনপির নেতার কাছ থেকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, ৩১ জানুয়ারি তারা অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র হাজির করবে। রোববার সংবাদ সম্মেলনে এসে এই প্ল্যাটফর্মের নেতারা বলেন, তারা ‘মুজিববাদী সংবিধান কবর দিতে চান’।
আগস্টে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ছন্নছাড়া আওয়ামী লীগের কোনও প্রতিক্রিয়া না এলে তা এসেছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, এ ধরনের কথা ‘ফ্যাসিবাদীদের মুখ থেকে আসে’।
আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের শাসনকালে প্রবল চাপে রেখেছিল বিএনপিকে। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো থেকে শুরু করে হামলা-মামলায় দলটির নেতাদের আটকে রাখার কৌশল নিয়েই চলছিল।
গত আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে সহায়ক রাজনৈতি শক্তি হয়ে থাকা বিএনপি শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আন্দোলনের নেতাদের প্রশংসাই করছিল। অভ্যুত্থানের পরপরই পুরোপুরি কারামুক্ত হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, যা তার দলের ছয় বছরের আন্দোলনেও হচ্ছিল না।
এরপর খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখাও করতে গিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তাদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়াসকে বিএনপি চেয়ারপারসন স্বাগতও জানিয়েছিলেন।
কিন্তু রাষ্ট্রপতি অপসারণ নিয়ে প্রথম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির প্রথম মতভেদ দেখা যায়। এরপর বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানালে অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা আবার তার বিরোধিতা করে। এরমধ্যে ছাত্রনেতাদের দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়েও সমালোচনা আসতে থাকে বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে।
এখন জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র উপস্থাপনের কর্মসূচি ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনের পর আবার প্রকাশ্য মতভেদ প্রকাশ পেল।
কী চান জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা একদিন আগেই বলেছিলেন, “শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী আমল থেকে বের হয়ে দেশ কেন জুলাই বিপ্লবের রূপ নিল, কীভাবে নিল, ৯ দফা থেকে ১ দফায় আমাদের কেন আসতে হলো, ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা কীরূপ ছিল- এসব বিষয় নিয়ে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র পাঠ করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।”
রবিবার এই প্ল্যাটফর্ম জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে তাদের ঘোষণাপত্র সম্পর্কে ধারণা দেন বলে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, আগামী ৩১শে ডিসেম্বর দেশে ‘মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে’ এবং আওয়ামী লীগ দল হিসেবে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়বে বাংলাদেশে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করা হবে জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “এই ঘোষণাপত্র ৫ই অগাস্টেই হওয়া উচিৎ ছিল, না হওয়ার ফলে ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিগুলো ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। দুই হাজারের ঊর্ধ্বে শহীদ এবং ২০ হাজারের ঊর্ধ্বে আহতদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে তারা এই আন্দোলনের ‘লেজিটেমেসি’কে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।
“জুলাই অভ্যুত্থান, যে গণঅভ্যুত্থানটি হয়েছে…তার মধ্য দিয়ে মানুষ মুজিববাদী সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই যে মানুষ মুজিববাদী সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তার একটি লিগ্যাল ডকুমেন্টেশন থাকা উচিৎ।”
তিনি জানান, ৩১ জানুয়ারি ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশে প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’ ঘোষণা করবেন তারা।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে সংবিধান স্বাধীনতার পর রচিত হয়েছে এবং ১৭ বার সংশোধনের পরও যা বলবৎ রয়েছে, তা এখন পুরোপুরি বদলে দেওয়ার পক্ষপাতি জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা।
হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “৭২ এর যে সংবিধানের বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়িয়েছে, মুজিববাদী চেতনার বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়িয়েছে, আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে মানুষ দাঁড়িয়েছে – আমরা চাই তার স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
“আমরা চাই এই মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে, যেখান থেকে এক দফা ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই শহীদ মিনার থেকেই মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক দল হয়ে পড়বে।”
সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক থেকে জুলাই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক হওয়া সারজিস আলম বলেন, “জুলাই বিপ্লবে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন একটি ঘোষণাপত্রে লিখিতভাবে লিপিবদ্ধ করা দরকার, সেটাই কিছুটা দেরিতে হলেও এই ঘোষণাপত্রে থাকবে। প্রয়োজনে সামনে এটি আরো সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন হতে পারে।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই ঘোষণাপত্রের খসড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে। তাদের বক্তব্য শুনে তা চূড়ান্ত করেই ৩১ ডিসেম্বর উপস্থাপন করা হবে।
‘এই ধরনের কথা ফ্যাসিবাদের মুখ থেকে আসে’
আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিবাদী’ আখ্যায়িত করে তাদের ক্ষমতা থেকে নামানোয় নেতৃত্ব দিয়েছিল জুলাই আন্দোলনের নেতারা। রবিবারের সংবাদ সম্মেলনে তাদের বক্তব্য শুনে উল্টো তাদেরই ফ্যাসিবাদী বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।
দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রবিবার দুপুরে ঢাকার নয়াপল্টনে একটি কমিউনিটি সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর কথার জবাব দেন মির্জা আব্বাস।
তিনি বলেন, “১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখভাগে থেকে অংশগ্রহণ করেছি। ১৯৭১ সালে আমার বহু বন্ধু শহীদ হয়েছে। শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে লেখা যে সংবিধান, সেই সংবিধানকে যখন কবর দেওয়ার কথা বলা হয়, তখন কিন্তু আমাদের কষ্ট লাগে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের উদ্দেশে বিএনপির প্রভাবশালী এই নেতা বলেন, “আমরা তোমাদের অগ্রজ হিসেবে কষ্ট পাই। কথাটা এভাবে বলা কী ঠিক হলো? ওই সংবিধানে যদি খারাপ কিছু থাকে, নিশ্চয়ই সেটা বাতিলযোগ্য।
“অনুরোধ করব, বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করবেন। ভুল বুঝবেন না। কবর দিয়ে ফেলব, মেরে ফেলব, কেটে ফেলব—এ সমস্ত কথা ভালো কথা নয়। এ ধরনের কথা ফ্যাসিবাদের মুখ থেকে আসে। আপনাদের মুখ থেকে এই ধরনের কথা আমরা আশা করি না।”
জুলাই অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব কোনো দল কিংবা সংগঠনের একার নয় বলে মন্তব্য করেন মির্জা আব্বাস।
তিনি বলেন, “যারা ৫ আগস্টের আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে, এককভাবে তারা এই আন্দোলনকে নিজেদের করে নিতে চায়। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন প্রায় নিভু নিভু, তখন কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সামনে এগিয়ে আসে। সাধারণ মানুষ সামনে এগিয়ে আসে। আমরা এগিয়ে যাই। বিএনপির ৪৬২ জন মারা গেছে।
“নিশ্চয়ই নেতৃত্বে একজন থাকবে। পেছনে হাজারো জন থাকবে। কিন্তু এককভাবে দাবি করা ঠিক না। এতে কিন্তু জনমনে বিভেদ সৃষ্টি হবে; বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে।”
অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের পছন্দে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য যে সময় নিচ্ছে, তারও বিরোধিতা করেন মির্জা আব্বাস।
তিনি বলেন, “সংস্কারের কথা বলছেন, যতটুকু লাগে করেন। আমাদের কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু যথাসময়ে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচন দেবেন।”
শেখ হাসিনা চলে গেলেও তার ‘প্রেতাত্মারা’ এখনও রয়ে গেছে মন্তব্য করে মির্জা আব্বাস বলেন, “এখনো ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ের আটজন ব্যক্তি সচিব হিসেবে মন্ত্রণালয়ে অবস্থান করছেন। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এত বিরোধিতার পরও দুই–তিন আগে আরেকজন সাবেক বাকশালী সচিবকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।”
“অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘বাকশালীদের প্রেতাত্মাদের বগলতলায় রেখে আপনারা কী সংস্কার করবেন? আমরা কি আওয়ামী লীগকে আবার ফিরিয়ে আনার রাস্তা করে দিচ্ছি?” অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন তিনি।