শুধু টয়লেট পেপার তৈরিতেই বিশ্বে প্রতিবছর কাটা পড়ে ১০ লাখের মতো গাছ। এভাবে গাছ কাটতে থাকলে মানবজাতি কতদিন টিকবে?
গাছের বিকল্প যে নেই তা নয়। যেমন, কেনিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর মেরুর কথাই ধরা যাক। এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নরম, রসালো পাতাযুক্ত একটি গাছ চোখে পড়বে।
এই শহরের বাসিন্দা বেঞ্জামিন মুতেমবেই প্লেকট্রানথাস বারবেটাস নামের এই গাছটি ব্যাপকভাবে লাগিয়েছেন। তবে তা খাবারের উৎস হিসেবে নয়। এর পাতা টয়লেট পেপার হিসেবে ব্যবহারের জন্য!
মুতেমবেইর ভাষ্য, নরম এবং সুবাসিত পাতার এই গাছ লাগানোটা তিনি রপ্ত করেছিলেন দাদার কাছ থেকে। এরপর ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি গাছটি লাগিয়ে আসছেন।
প্লেকট্রানথাস বারবেটাস গাছটি সাধারণত দুই মিটার (৬.৫ ফুট) পর্যন্ত বড় হয়। এর পাতার আকৃতি কারখানায় তৈরি চৌকোনা টয়লেট পেপারের মতোই অনেকটা। পাতা থেকে আমাদের পরিচিত পুদিনা এবং লেবুর মতো সুগন্ধ ছড়ায়। আঁশযুক্ত পাতা বেশ নরম।
গাছটি উষ্ণ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় এবং কিছু সূর্যালোক পাওয়া যায়, আফ্রিকার এমন এলাকায় ব্যাপকভাবে জন্মায়। কখনো কখনো এই গাছ সেখানকার বাড়িঘর কিংবা কোনো সম্পত্তির সীমানা নির্ধারণেও ব্যবহার হয়।
“অনেকদিন ধরেই এটি (পাতা) আফ্রিকান টিস্যু হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আমরা সবাই ঘরের কাজে এটি ব্যবহার করি। যখন গাছের সব পাতা তুলে ফেলা হয়, শুধু তখনই আমি টয়লেট পেপার কিনি,” বলেন মুতেমবেই।
কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় আফ্রিকায় অনেক পণ্যের মতো টয়লেট পেপারও এখন চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। কেনিয়া অ্যাসোসিয়েশন অব ম্যানুফ্যাকচারার্স এর তথ্য অনুযায়ী, কাঁচামালের উচ্চমূল্যের কারণে এখন টিস্যু উৎপাদনের ব্যয় আগের তুলনায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
বিশ্বে এখন গাছ থেকে তৈরি করা টয়লেট পেপারেরই দাপট। নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ফরেস্ট বায়োমেটেরিয়ালস বিভাগের অধ্যাপক রোনাল্ডস গঞ্জালেজ বলছেন, এখন ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ টয়লেট পেপার শক্ত কাঠের তন্তু এবং বাকিটা নরম কাঠের তন্তু থেকে তৈরি হচ্ছে।
আর এই টয়লেট পেপার তৈরিতেই বিশ্বে প্রতিদিন প্রাণ দিতে হচ্ছে আনুমানিক ১০ লাখ গাছকে। এটি পরিবেশের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করা কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান ‘এইজ’ এর তথ্য।
সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নতুন গাছ ব্যবহার হয় এই কাগজ শিল্পে, আর এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ ব্যবহার হয় কাগজ উৎপাদনে।
ইথিকাল কনজ্যুমার প্রতিবেদন বলছে, এতে বনভূমি উজাড় হওয়া, জীববৈচিত্র ক্ষতি, ভূমিক্ষয়, বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি এবং বাস্তুতন্ত্রের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে ব্যাপকভাবে।
উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ, কেনিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়ামের ভেষজবিদ মার্টিন ওধিয়াম্বো মনে করেন, টয়লেট পেপারের জন্য গাছ কাটার পরিবেশগত প্রভাবের সমাধান কেনিয়াতেই হতে পারে।
“প্লেকট্রানথাস বারবেটাস হল আফ্রিকান টয়লেট পেপার। অনেক তরুণ-তরুণী গাছটি সম্পর্কে জানেন না, কিন্তু এর টয়লেট পেপারের একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,” বলেন তিনি।
তবে কেনিয়াতে কত সংখ্যক মানুষ এই গাছের পাতা টয়লেট পেপার হিসেবে ব্যবহার করে, তার অফিসিয়াল পরিসংখ্যান নেই। তবে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলেই ব্যাপকভাবে জন্মায় এই গাছ এবং সহজেই পাওয়া যায় এমন অনেক গ্রামীণ এলাকায় এখনো নিয়মিত ব্যবহার হয় বলে জানান ওধিয়াম্বো।
প্লেকট্রানথাস বারবেটাস কলম থেকে পূর্ণাঙ্গ উচ্চতায় পৌঁছায় ১-২ মাসের মধ্যে। একেকটি কলমের দাম ৫০ কেনিয়ান শিলিং (০.৩৭ সেন্ট)।
কেনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই নাইরোবির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে আসেন ওধিয়াম্বোর বোটনিক্যাল গার্ডেন থেকে গাছটির চারা সংগ্রহ করতে। তারা ওধিয়াম্বোর কাছ থেকে গাছটি সম্পর্কে নানা তথ্যও জেনে নেন।
প্লেকট্রানথাস বারবেটাস গাছটির কথা এরই মধ্যে কেনিয়ার বাইরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রবিন গ্রিনফিল্ড নামের একজন পরিবেশবাদী গত পাঁচ বছর ধরে এই গাছের পাতা ব্যবহার করছেন।
গ্রিনফিল্ড ফ্লোরিডায় বসবাসের টেকসই উপায় নিয়ে একটি অলাভজনক সংস্থা চালান।
‘নিজে টয়লেট পেপার নিজেই তৈরি করুন’ এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এর অংশ হিসেবে ফ্লোরিডায় নিজের নার্সিারিতে ১০০ প্লেকট্রানথাস বারবেটাস গাছ উৎপাদন করেছেন। শুধু তাই নয়, বিনামূল্যে গাছটির চারা বিতরণ করে লোকজনকে নিজেদের টয়লেট পেপার উৎপাদনে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে কয়েকশ জনকে এই গাছের চারা দিয়েছেন।
গ্রিনফিল্ডের ভাষ্য, টয়লেট পেপারের জন্য গাছের পাতা ব্যবহারকে অনেকেই দারিদ্র্য হিসেবে দেখেন। কিন্তু টয়লেট পেপার তো সেই গাছ থেকেই তৈরি হচ্ছে।
যেখানে এখনো ব্যাপকভাবে লাগানো হচ্ছে না, সেক্ষত্রে গাছটির ব্যবহার আরো ছড়িয়ে পড়বে, তেমন বাস্তবতা কতটুকু?
অন্যদিকে টয়লেট পেপার প্রস্তুতকারক ইউরোপের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান ডব্লিউইপিএর মতো অনেক প্রতিষ্ঠানই টয়লেট পেপার উৎপাদনের পরিবেশগত প্রভাব কমানোর চেষ্টা শুরু করেছে। ডব্লিউইপিএ এরই মধ্যে পুনঃপ্রক্রিয়াজত করা কার্ডবোর্ড ব্যবহারের টয়লেট পেপার উৎপাদনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। এতে তন্তুগুলোকে ব্লিচ করার বিষয়ও নেই।
সাধারণত কাগজে পরিণত করার আগে কাঠের মণ্ডে ব্লিচ মেশানো হয়। এর মধ্যে দিয়ে পরিবেশে ক্লোরিনের উপাদান ছড়িয়ে পড়ে। যা ক্যান্সার ছাড়াও নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে ন্যাচারাল রিসোর্সেস ডিফেন্স কাউন্সিল বলছে।
তবে এই ‘টয়লেট পেপার’ গাছ এই খাতে খুব কমই প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে করছেন ডব্লিউইপিএর মুখপাত্র।
একটি সমস্যা হচ্ছে ব্যবহারের এটি ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। বিশেষ করে ইউরোপে এই ধরনের টয়লেট পেপার ধ্বংসের কোনো প্রক্রিয়া নেই। সেখানে শুধু পানিতে দ্রবণীয় জিনিসই ফ্ল্যাশ করা সম্ভব।
এখানেই চলে আসে কম্পোস্ট টয়লেটের বিষয়টি।
“আমি একটি কমপোস্ট টয়লেট ব্যবহার করি। পাতাগুলো আবার মাটিতে মিশে মাটিই তৈরি করে, যা খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। এটি একটি ‘ক্লোজড-লুপ’ পদ্ধতি এবং আমি মনে করে, এই পাতার ব্যবহার আমাদেরকে কম্পোস্টের পরিবেশগত সুবিধা নিয়ে আলোচনায় উৎসাহ জোগাবে,” বলেন গ্রিনফিল্ড।
অল্পকিছু দেশে এবং জায়গায় জন্মায় এই প্লেকট্রানথাস বারবেটাস গাছটি। এটিও একটা সমস্যা বলে মনে করেন মিসৌরি বটানিক্যাল গার্ডেনের সহকারী বিজ্ঞানী উইন্ডি অ্যাপলকুইস্ট।
যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার কথাই বলা যায়। সেখানে এই গাছটিকে ক্ষতিকর হিসেবে দেখা হয় এবং সেখানে এটি লাগানো কিংবা বিক্রি নিষিদ্ধ।
বিজ্ঞানী অ্যাপলকুইস্ট বলছেন, নির্দিষ্ট জায়গায়, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এবং নজরদারির মাধ্যমে গাছটির জন্মানো নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিবেশগত ঝুঁকি কমানো যেতে পারে।
তবে মূলধারার টয়লেট পেপারের কাতারে যাওয়াটাই এই গাছের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা। মানুষেরন কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে, সেটিও ভাবতে হবে।
কিন্তু নাইরোবির নার্সারি নিয়ে এখনো আশাবাদী ওধিয়াম্বো।
“আমি জানি, কিছু মানুষ গাছের পাতাকে টয়লেট পেপার হিসেবে ব্যবহার করাকে এক ধাপ পিছিয়ে যাওয়া হিসেবে মনে করে। কিন্তু এই গাছের যে সুবিধার কথা আমি জানি, তাতে বিশ্বাস করি, এটিই হতে যাচ্ছে পরবর্তী সবুজ বিকল্প।
“আমরা যদি খোলা মন নিয়ে গাছটি নিয়ে প্রচার চালিয়ে যাই, তাহলে এক সময় ব্যাপকভাবে এটি ব্যবহারের জন্য বড় পরিসরে উৎপাদন করতে পারব।”