ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মরদেহ তার নিজের ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি না মেলায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদী পোস্টে ছেয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় এই শিক্ষকের এমন বিদায় মেনে নিতে পারছেন না তারা। ক্ষোভ প্রকাশ করতে ছাড়েননি তার ছাত্রছাত্রীদের বাইরে সাধারণ মানুষজনও।
বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক। মৃত্যুর পরই আলোচনা চলছিল শেষ বিদায় জানাতে এই শিক্ষকের মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়া হবে কিনা।
তবে তড়িঘড়ি করেই জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’ এবং ‘তার স্বজনদের ইচ্ছায়’ মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নেওয়া হচ্ছে না। সেখানে পড়ানোও হবে না জানাজা।
শেষমেশ শুক্রবার দুপুরে ধানমণ্ডিতে একটি মসজিদ প্রাঙ্গণে তার জানাজা শেষে সমাহিত করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে।
জানাজায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানও অংশগ্রহণ করেন, যিনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সম্প্রতি।
এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ও পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার জানাজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে না।”
জানাজা কিংবা ‘শেষ শ্রদ্ধা’ জানানোর জন্য আরেফিন সিদ্দিকের মরদেহ তার ৪০ বছরের কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢোকাতে না দেওয়ায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমালোচনা করে জনপ্রিয় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক ফেইসবুকে লিখেছেন, একজন শিক্ষকের লাশকেও এত ভয়?
তার পুরো লেখাটি ছিল এরকম: “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. আরেফিন সিদ্দিক স্যারের জানাজা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ বা শহীদ মিনারে করতে অনুমতি মিলেনি। একজন শিক্ষকের লাশকেও এত ভয়?”
পোস্টটি শেয়ার হয়েছে কয়েকশ, মন্তব্যের ঘরে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন হাজার খানেক অনুসারী, যার বেশিরভাগই এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন, প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ।
আবার কয়েকজন বিগত সরকারের সময়েও এরকম অনুশীলনের কথা তুলে ধরেছেন।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক প্রথম দফায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি।
এর প্রায় সাড়ে চার বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়। নির্বাচনের পর ২০১৩ সালের ২৫ অগাস্ট প্যানেলে থাকা তিনজনের মধ্যে আরেফিন সিদ্দিককে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব দেয় সরকার।
উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার আগে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের নীল দলের নেতা আরেফিন সিদ্দিক দুই মেয়াদে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
আরিফ জেবতিকের পোস্টের নিচে ‘টাইটেনিয়াম পীথাগোরাস’ নামে আইডি থেকে একজন মন্তব্য করেছেন: “মতিয়া চৌধুরীর লাশ কবর করতে (দিতে) দিলো না ইউনূস সরকার, আর (এটা) তো ঢাবি, ঐটাতো এখন একটা বস্তি।”
কাজী শাহরীন হক, যিনি গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এবং প্রায় এক দশক সাংবাদিকতা করেছেন, তিনি লিখেছেন: “আমি আরেফিন স্যারের ছাত্রী, তাকে আমার ক্যাম্পাস প্রাঙ্গন থেকেই শেষ বিদায় জানাতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সরাসরি বলছি, ব্যবস্থা করেন। নিজেদের মানসম্মান ধরে রাখতেই মেরুদণ্ডটা সোজা করে ব্যবস্থা করেন। কথা শেষ।”
শাহরীন হকের ‘শেষ কথা’ থাকলেও শেষটা কেমন ছিল তা এখন আর অজানা নয়।

অনলাইন সংবাদপত্র সকাল-সন্ধ্যার সাংবাদিক ও আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সরাসরি ছাত্র প্রদীপ চৌধুরী ফেইসবুকে তার প্রিয় শিক্ষকের ফুলে ফুলে ঢাকা কবরের ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, “স্যার, আপনার প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অকৃত্রিম, সীমাহীন। আপনার হিমালয় সমান ব্যক্তিত্বের কাছে ওরা আজ পরাজিত।”
ভিন্ন আরেকটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্ভবত জানে না, মিথ্যা কত প্রকার আর কিভাবে তা ব্যবহার করে থাকে মিথ্যাবাদীরা; সেটা ‘কমিউনিকেশন ক্লাসে’ আরেফিন স্যার আমাদের শিখিয়ে গেছেন। তাই স্যারের জানাজা নিয়ে ঢাবি কর্তৃপক্ষের মিথ্যাচার আমরা খুব সহজেই ধরতে পেরেছি।
“টেনশন নিয়েন না আপনারা। দেশের গণমাধ্যম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা স্যারের অসংখ্য ছাত্র-অনুরাগী-শুভাকাঙ্ক্ষী আজকের ঘটনা ভুলে যাবে না।”
একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাংবাদিক গোলাম মুর্তজা অন্তু ফেইসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতিনীতি যারা জানেন তাদের অনেকের মতো আমিও ধরেই নিয়েছিলাম যে স্যারের মরদেহ শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও জানাযার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নেওয়া হবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে হাসপাতালে উপস্থিত বন্ধু ও সতীর্থরা জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিচ্ছে না।
“একটা মানুষ মরে লাশ হয়ে গেছে। তাকে কি ভয় পাচ্ছেন? নাকি ভাবছেন তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে না দিলে বিরাট বীরত্বের কাজ হবে?”
দৃষ্টিকোণ একাত্তরের সঞ্চালক শায়লা আহমেদ লোপা ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, “সদ্যপ্রয়াত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. আরেফিন সিদ্দিক স্যারের জানাজা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ বা শহীদ মিনারে হচ্ছে না । যথাযথ কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয় নাই । জানতাম ওরা দিবে না !”
অশীত সিংহ রায় নামে একজন পোস্ট দিয়েছেন, “এটাও শুনতে হলো যে একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ভিসিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় শেষ বিদায়ের অনুমতি নাই! বড়ই বেদনাদায়ক ও লজ্জাজনক।”
মতিউর রহমান নামে আরেকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, “কুশিক্ষিত ড. ইউনূস উগ্র মৌলবাদীদের ঈমাম, এই বাংলায় এসব অপকর্মের জন্য একদিন চড়া মাশুল দিতে হবে। ধিক্কার।”
এ সম্পর্কিত আরও খবর: