যখন আলোচনার কেন্দ্রে, তখন কী বললেন সেনাপ্রধান

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে সেনা মালঞ্চে ইফতার অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান।
জুলাই অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে সেনা মালঞ্চে ইফতার অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান।

গত বছরের ৫ আগস্ট আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছিলেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত দিনে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর তার কাছ থেকেই প্রথম শুনেছিল দেশবাসী।

মাঝে কিছুদিন গুটিয়ে থাকলেও গত ফেব্রুয়ারির শেষে হঠাৎ খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসেন জেনারেল ওয়াকার; নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে বেশ চড়া সুরে কথা বলেন তিনি। সরকার, রাজনৈতিক দলগুলোকে হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।

তার পরের মাসে এসে আবার আলোচনার কেন্দ্রে তিনি। তবে এবার অভিযোগবিদ্ধ তিনি অভ্যুত্থানের নেতাদের দিক থেকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে পরিশুদ্ধ করে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে চাপ দেওয়ার।

এনিয়ে যখন অভ্যুত্থানের নেতারাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে আলোচনা তুঙ্গে, তখন ঢাকা সেনানিবাসে এক ইফতার মাহফিলে এলেন সেনাপ্রধান, সেখানে বক্তব্যও দিলেন।

প্রথম আলো প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের সম্মানে রোববার সেনা মালঞ্চে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে সেনাপ্রধান তাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত বছরের জুলাইয়ে, তা অভ্যুত্থানে রূপ নেওয়ার আগে সংঘাত-সহিংসতায় কয়েকশ মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হন।

তাদের জাতির কৃতী সন্তান আখ্যায়িত করে জেনারেল ওয়াকার বলেন, “আপনারা কখনো মনোবল হারাবেন না। মনোবল হারানোর কিছু নেই। আপনারা এ দেশ ও জাতির জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন। আমি আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এবং আপনাদের এই অ্যাসুরেন্স (নিশ্চয়তা) দিচ্ছি, সব সময় পাশে থাকব।”

আহতদের জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নেওয়া পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ২০০ এর ওপরে চিকিৎসা দিয়েছি এবং দিয়ে যাচ্ছি।

“আমাদের এই সাহায্য-সহযোগিতা সব সময় জারি থাকবে। আমরা চেষ্টা করব, একটা রিহ্যাবিলিটেশনের (পুনর্বাসন) জন্য। সেদিকেই ইনশাআল্লাহ আমরা চেষ্টা করে যাব। এবং এই আর্থিক সাহায্য–সহযোগিতা আপনাদের সব সময় জারি থাকবে।”

অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান বিভিন্ন টেবিল ঘুরে আহত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের খোঁজ-খবর নেন, কারও কোনো সমস্যা রয়েছে কি না, তা জানতে চান। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের হাতে ঈদ উপহারও তুলে দেওয়া হয়।

জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ যখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টার অভিযোগ তুললেন, তখন নীরব থাকলেও ইফতার মাহফিলের মধ্য দিয়ে দৃশ্যত একটি জবাবই দিলেন জেনারেল ওয়াকার।

আওয়ামী লীগ আমলের শেষ দিকে গত বছরের জুন মাসে সেনাবাহিনী প্রধান হিসাবে নিয়োগ পান ওয়াকার-উজ-জামান। বৈবাহিক সূত্রে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার আত্মীয়তা তখন আলোচনায় উঠেছিল।

তার পরের মাসেই জুলাই আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনীও নামিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু সেনাবাহিনী শেষ দিকে বেঁকে বসায় আর টিকে থাকতে পারেননি শেখ হাসিনা।

সেনাবাহিনীর তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার কারণ সম্প্রতি স্পষ্ট হয় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্কের কথায়। তিনি বলেছিলেন, সরকারের নির্দেশে দমন-পীড়নে যুক্ত না হতে তখন তারা সেনাবাহিনীকে শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে সেনা মালঞ্চে ইফতার অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান।

অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত দিনে তৎপর থাকলেও পরে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেবে না বলে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন জেনারেল ওয়াকার। ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত তার কোনো চড়া গলা শোনা যায়নি।

গত শুক্রবার হাসনাত আব্দুল্লাহ দাবি করেন, গত ১১ মার্চ সেনাসদরে এক বৈঠকে জেনারেল ওয়াকার আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরতে দিতে তাদের রাজি হতে চাপ দিয়েছিলেন।

ফেইসবুকে এনিয়ে লেখার পাশাপাশি অভ্যুত্থানে তার সহযোদ্ধা, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার একটি ভিডিও শেয়ার দেনে, যেখানে আসিফ বলছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা পদে মুহাম্মদ ইউনূসকে মানতে সেনাপ্রধান নারাজ ছিলেন। তিনি এনিয়ে চাপাচাপিও করেছিলেন।

হাসনাতের বক্তব্য নিয়ে ঝড় উঠলেও সেনাবাহিনীর পক্ষে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) কোনো বক্তব্য দেয়নি। তবে সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজের দাবি, তাদের কাছে দেওয়া এক বক্তব্যে সেনাসদর হাসনাতের কথাকে ‘অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ক গল্পের সম্ভার’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। হাসনাত রাজনৈতিক স্টান্টবাজি করছেন বলেও সেনাসদরকে উদ্ধৃত করে জানায় এই অনলাইন পত্রিকা।

হাসনাতের সঙ্গে ওই বৈঠকে যাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক নেতা সারজিস এরপর রোববার হাসনাতের সঙ্গে কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে ফেইসবুকে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি বোঝাতে চান, সেনাপ্রধান তাদের কোনো ধরনের চাপ দেননি। তিনি কিছু বিষয়ে মতামত দিয়েছিলেন।

অভ্যুত্থানের নেতারা নতুন যে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, সেই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠকের দায়িত্বে হাসনাত ও সারজিস দুজনই রয়েছেন।

তাদের দুই রকম বক্তব্যে দলের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। তবে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেছেন, তাদের নেতাদের মধ্যে দূরত্ব বা বোঝাপড়ার কোনো ঘাটতি নেই। তবে কোনো জায়গায় ভুল হলে তারা ক্ষমাপ্রার্থী।

“একটি বিশাল গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, আন্দোলন ও পলিটিক্যাল জায়গা দুইটা আলাদা। সেই জায়গা থেকে এই গণঅভ্যুত্থানের শিক্ষার্থীরা নিজেদের পলিটিক্যাল জায়গায় ট্রান্সফরমেশন করছেন। সেখানে কিছু ক্ষেত্রে যদি ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে, দেশবাসীকে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।”

আরও পড়ুন