কৃত্রিম আবেগের অকৃত্রিম স্পর্শে আর্নেস্তোর গল্প

গানটির প্রকৃত গায়ক ও সুরকারের খোঁজ করা হচ্ছিল ইউটিউবে আসার পর থেকেই।
গানটির প্রকৃত গায়ক ও সুরকারের খোঁজ করা হচ্ছিল ইউটিউবে আসার পর থেকেই।

আর্নেস্তোর গল্পটি হয়ত এরই মধ্যে অনেকের জানা হয়ে গেছে। হবেই না বা কেন, এক মাস ধরে সোশাল মিডিয়ায় রীতিমতো ভাইরাল তার গান। সন্তানের জন্য তার আকুতি স্পর্শ করছে সবার হৃদয়।

কে এই আর্নেস্তো? তিনি নিজেই তা বলেছেন রিয়্যালিটি শো ‘আমেরিকা’স গট ট্যালেন্ট’ এ। তিনি একজন কাঠমিস্ত্রি; বয়স ৫৪ বছর। দীর্ঘ সাদা চুল, প্রায় পাকা গোঁফ-দাড়িতে শ্রমিকের পোশাকে থাকা আর্নেস্তোর বয়স এর চেয়ে বেশিই দেখায়।

এই অকাল বার্ধক্যের কারণও খুঁজে পাওয়া যায় তার গানে। ‘I’m still waiting at the door’ গানে আর্নেস্তো শুনিয়েছেন তার জীবনের গল্প। হাতের রক্ত ঝরিয়ে যে বাড়ি বানিয়েছিলেন তিনি সন্তানের জন্য, স্ত্রীর জন্য; তারা তাকে ছেড়ে চলে গেছে দূরে।

স্ত্রী গত হয়েছেন, এখন ছেলের অপেক্ষায় আছেন আর্নেস্তো। তিনি বলেছেন, এই বয়সে তার এই শো-তে অংশ নেওয়া নাম-যশ কামাইয়ের উদ্দেশ্যে নয়, তার চাওয়া- যদি তার ছেলে এই গান শুনে ফিরে আসে।

আর্নেস্তোর গানটি হৃদয় ছুঁয়ে যায় অনুষ্ঠানের বিচারকদেরও, দর্শকদের চোখেও নামায় জল। অন্তত তার গানের ভিডিওতে তাই দেখা যাচ্ছে।

এই ভিডিও ফেইসবুক, ইউটিউব, টিকটকে ছড়িয়ে পড়ে ভীষণ দ্রুত গতিতে; কয়েক কোটি মানুষ এরই মধ্যে দেখে ফেলেছে আর্নেস্তোকে, শুনে ফেলেছে তার গান, হয়েছে বেদনাহত। তার নামই হয়ে গেছে ‘আর্নেস্তো দ্য কার্পেন্টার’।

শুধু তাই নয়, প্রতিটি ভিডিওর মন্তব্যের ঘরে জমা পড়ছে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, তার মধ্যে দুটি প্রশ্নই বেশি আসছে। তা হলো- বেচারা আর্নেস্তোর ছেলেটি কি তার ডাকে সাড়া দিয়েছে? এই কাঠমিস্ত্রি কি খুঁজে পেয়েছেন তার ছেলেকে?

এর বাইরে যারা আর্নেস্তো সম্পর্কে আরও জানতে চাইছেন, তাদের পড়তে হচ্ছে হয়রানিতে, কারণ তার সম্পর্কে কিছুই জানা যাচ্ছে না ইন্টারনেটে। এমনকি আমেরিকা’স গট ট্যালেন্টের এমন কোনও এপিসোডও পাওয়া যাচ্ছে না।

মূল গানটি আসলে কার? এটি কি আর্নেস্তোর নিজের লেখা? নিজের সুর করা? নাকি অন্য কারো গান উঠে এসেছে তার বেদনাহত কণ্ঠে? কোনো প্রশ্নেরই উত্তর মিলছে না।

সোশাল মিডিয়ায় সাড়া দেখে যুক্তরাজ্যের দৈনিক গার্ডিয়ান এই গানের ঠিকুজি তালাশে নামে অভিযানে। তাতে প্রথমে দেখা যায় একটি গড়বড়।

চোখে জল আসা বিচারকদের মধ্যে সাইমন কাওয়েল, সোফিয়া ভারগারার সঙ্গে নিক গ্রিমশকে যখন দেখা যায়, তখনই প্রশ্ন আসে। তিনি তো আমেরিকান এই শোতে বিচারক ছিলেন না কখনো। তিনি তো একজন ব্রিটিশ রেডিও উপস্থাপক।

এরপর ডেভিড উইলিয়ামস, আমান্ডা হোল্ডেন, শেরিল টুইডিকে কাঁদতে দেখা যায়, তারাও এই অনুষ্ঠানের বিচারক নন। তাহলে? আরও খুঁটিয়ে দেখলে দর্শকদেরও বেমানান প্রতিক্রিয়াও চোখে ধরা পড়ে।

এরপর আরও নিবিড়ভাবে দেখলে আর্নেস্তোরই নড়াচড়ায় ভারসাম্যহীনতা, তার সন্দেহজনক মসৃণ ত্বকের গঠন ইত্যাদি ধরা পড়ে অনুসন্ধানী চোখে।

তার মানে কী? ডিপফেক স্ক্যাম নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা সহজেই উত্তর দেবেন- এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা।

গার্ডিয়ান লিখেছে, “হ্যাঁ, একজন নিঃসঙ্গ কাঠমিস্ত্রির এই হৃদয়বিদারক গল্পটি আসলে এআইর (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) তৈরি। এটি ইউটিউব অ্যাকাউন্ট AGTverseai তৈরি করেছে, যারা বিভিন্ন ট্যালেন্ট শো থেকে ভিডিও সংগ্রহ করে এআই দিয়ে গানের পারফরম্যান্সের ভিডিও তৈরি করে। আর গানগুলোও সম্ভবত এআই বা এআইর সহায়তায় তৈরি।”

AGTverseai এর নিজস্ব চ্যানেলে অবশ্য এআই ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বলেছে, এটি কাল্পনিক, এটি তৈরি করা হয়েছে বিনোদনের জন্য। এটিকে সত্য হিসাবে গ্রহণ করা ঠিক হবে না।

কিন্তু আর্নেস্তোর ভিডিও তো শেয়ার করছেন অনেকে, সেখানে সাদা চোখে দেখে কেউ ভাবতে পারছে না যে এটি এআই দিয়ে বানানো।

ভিডিওটি ইউটিউবের দুটি চ্যানেলেই প্রায় আড়াই কোটি বার দেখা হয়েছে, টিকটকে একটি পোস্ট দেখা হয়েছে ৩ কোটিরও বেশি বার। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামেও দেখেছেন অসংখ্য মানুষ।

রিয়েল আর ভার্চুয়াল- এই দুই জগতের সীমারেখা টানা যে এখন কঠিন হয়ে পড়েছে, তার একটি উদাহরণ আর্নেস্তোর এই গান। ফ্যাক্টচেকিং সাইট স্নোপস ভিডিওটি ভুয়া বলে রায় দিয়েছে। কিন্তু তাতে কী আসে যায়, অসংখ্য মানুষ বিশ্বাস করছে যে আর্নেস্তো একটি বাস্তব চরিত্র।

আবার অনেকে বুঝতে পারছেন ভিডিওটি এআই দিয়ে বানানো। কিন্তু তবুও আর্নেস্তোকে ভালোবাসছেন। একজন ইউটিউবার বলেন, “আমি ভাবতে পারিনি যে এআই এতটা আবেগ তৈরি করতে পারবে!”

এআই দিয়ে তৈরি আবেগপূর্ণ এমন নানা ভিডিও ভীষণ বেগে ছড়িয়ে পড়ছে সোশাল মিডিয়ায়। একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একজন অপরাধী কারাগারে ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার গান গাইছে। আরেকটিতে দেখা যাচ্ছে, ক্যান্সার আক্রান্ত এক নারী গানে সান্ত্বনা খুঁজে নিচ্ছেনে। আরেক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক সৈনিক ৯৫ বছর বয়সে এসে তার মৃত এক সহযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।

এগুলোর সবক’টিই এক অর্থে ভুয়া। কিন্তু তাও ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না, যখন এই ভুয়া চরিত্রগুলোই সত্যিকারের মানুষের আবেগকে ছুঁয়ে যায়।

আরও পড়ুন