সাঁড়াশি অভিযানে আটক ১৩০৮, প্রায় সবাই আ. লীগের নেতাকর্মী

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

সারা দেশে যৌথবাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ অভিযানে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন এক হাজার ৩০৮ জন, যাদের সবাই আওয়ামী লীগ অথবা এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী।

এর মধ্যে মহানগর এলাকায় ২৭৪ জন এবং অন্যান্য এলাকা থেকে এক হাজার ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই অভিযানের শুরু সেই গাজীপুরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ও ছাত্রলীগের ৪০ নেতাকর্মীকে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল দ্য সান ২৪ কে বলেন, “আসল ডেভিল জঙ্গিরা তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে; ওরা তো ডেভিল হান্টের নামে এখন আওয়ামী লীগকে হান্ট করছে, গ্রেপ্তার করছে। যদি একটা জঙ্গি ধরতো, সারাদেশে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের সঙ্গে যুক্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতো তাহলে নামের যথার্থতা বোঝা যেত। এখন তো দেখা যাচ্ছে এই অপারেশন জঙ্গি, সন্ত্রাসী, অপরাধীদের রক্ষার অপারেশন।”

“জেল ভেঙে এতগুলা জঙ্গি আর দাগি অপরাধী পালিয়ে গেল, এত এত আগ্নেয়াস্ত্র আর গোলাবারুদ লুট হয়ে গেলো, সেগুলো তো উদ্ধার হতে দেখলাম না।”

তিনি অভিযোগ করেন, “দেশের কারাগারগুলো থেকে দাগি আসামি, জঙ্গিদের ছেড়ে দিয়ে কারাগার ফাঁকা করছে, যাতে করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দিয়ে ভরে নিতে পারে। আর যদি আরও বিস্তৃতভাবে বলি, তাহলে বলতে হয়- বাংলাদেশটাই তো একটা কারাগার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে স্থানান্তর করে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না,” যোগ করেন বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত এই নেতা।  

রোববার বিকেল পর্যন্ত পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো।

গাজীপুর

গাজীপুরে অপারেশন ডেভিল হান্ট এর অভিযানে রোববার বিকেল পর্যন্ত ১২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরমধ্যে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ ৮৫ জনকে এবং গাজীপুর জেলা পুলিশ ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করে। এদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থক।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ-উত্তর) রিয়াজ উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, গাজীপুর মহানগরের ৮টি থানা এলাকা হতে এ পর্যন্ত (বিকেল সাড়ে ৪টা) মোট ৮৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেক জানান, রোববার বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেলার ৫টি থানা (কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া, জয়দেবপুর, শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর) এলাকা হতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরর বেশিরভাগ আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।

চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম নগরে অভিযান চালিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও ১৯ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

রোববার বিকেলে নগর পুলিশের জনসংযোগ শাখা থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শনিবার দুপুর ২টা থেকে রোববার দুপুর ২টা পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলাসহ বিশেষ ক্ষমতা ও সন্ত্রাস বিরোধী আইনে এক বা একাধিক মামলা রয়েছে।

রংপুর

রংপুর মহানগরীসহ বিভাগে ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথবাহিনী। এর মধ্যে রংপুর মহানগরীতে পাঁচজন ও বিভাগে ১৪ জন রয়েছেন। সবাই আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী।

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলী সাংবাদিকদের জানান, রোববার ভোর ৬টা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাজহাটে দুই ও কোতোয়ালি, হারাগাছ এবং মাহিগঞ্জ থানা এলাকা থেকে একজন করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অন্যদিকে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আমিনুল ইসলাম জানান, আট জেলার মধ্যে কুড়িগ্রামে ছয়, দিনাজপুরে তিন, ঠাকুরগাঁওয়ে দুই ও গাইবান্ধা, পঞ্চগড় এবং লালমনিরহাট থেকে একজন করে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা, হত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ নাশকতা, পরিকল্পনা এবং অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

গোপালগঞ্জ

যৌথ বাহিনী গোপালগঞ্জ পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান জানান, জেলায় অভিযান চালিয়ে গোপালগঞ্জ পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম মানিকসহ চারজনকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। রোববার বিকেলেআদালতের মাধ্যমে তাদের জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।

খাগড়াছড়ি

খাগড়াছড়ির গুইমারায় ছাত্রলীগের চার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শনিবার রাতে গুইমারার বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে গুইমারা থানা পুলিশ।

গ্রেপ্তারদের মধ্যে সোহাগ মিয়া গুইমারার হাফছড়ি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি এবং অন্যরা কর্মী।

নোয়াখালী

নোয়াখালী হাতিয়ায় যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

হাতিয়া থানার ওসি এ কে এম আজমল হুদা গণমাধ্যমকে জানান, হাতিয়া উপজেলার চরঈশ্বর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আজাদসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, নৌ পুলিশ ও পুলিশের যৌথ অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

শেরপুর

শেরপুরে ছাত্রলীগের নেতা মাহমুদুল হাসান রুবেল ও রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে ঝিনাইগাতি থানা পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার রাত ৯টার দিকে ঝিনাইগাতি থানার একটি টহল দল শেরপুর-তিনানী সড়কের হাসলিগাঁও এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। এসময়  ছাত্রলীগের দুই নেতা মাহমুদুল হাসান রুবেল ও রফিকুল ইসলাম দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে।

মাহমুদুল হাসান রুবেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক। আর রফিকুল ইসলাম ঝিনাইগাতি উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি।

লক্ষ্মীপুর

লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরলরেন্স ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নুরুল করিমকে গ্রেপ্তার করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, শনিবার রাতে কমলনগরের চরলরেন্স গ্রামের বাড়ি থেকে নুরুল করিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার অভিযোগ রয়েছে। তাকে লক্ষ্মীপুরে জেলা শহরের ৪ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

গাজীপুরে শুক্রবার গভীর রাতে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করতে গিয়ে এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে আহত হন অন্তত ১৪ জন। যাদেরকে পরবর্তীতে নিজেদের কর্মীসমর্থক বলে দাবি করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন।

এ ঘটনার পর শনিবার গাজীপুরে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। তারা আওয়ামী লীগ ও এর অনুসারীদের গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টা সময় বেধে দিয়ে আল্টিমেটাম দেওয়ার পর সিদ্ধান্ত আসে সরকার সারাদেশে অভিযান পরিচালনা করবে।

এছাড়া প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় গাজীপুর সদর থানার ওসিকে।

সরকারিভাবে এই সাঁড়াশি অভিযানকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে প্রচার করা হলেও কেন এরকম নাম সেবিষয়ে সরকারি কোনো পর্যায়ের স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ছাত্রলীগের ফেসবুক পেজে সাবেক প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ৫ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙা শুরু করে। এরপর বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও দলটির নেতাদের বাড়িতে হামলা চালায়।

পরবর্তীতে এসব ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ৭ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজ থেকে দেওয়া হয় বার্তা- কঠিন হাতে এসব কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করা হবে।

অবশ্য এরপরও বিভিন্ন এলাকায় অব্যাহত ছিল হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ।  

হঠাৎ কেন সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান?  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads