যোগী রাজ্যের বুলডোজার ইউনূসের বাংলাদেশেও, ধ্বংস বঙ্গবন্ধুর বাড়ি

বঙ্গবন্ধু ভবন ধ্বংস করতে বুধবার রাতে নেওয়া হয় বুলডোজার।
বঙ্গবন্ধু ভবন ধ্বংস করতে বুধবার রাতে নেওয়া হয় বুলডোজার।

ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ; কট্টর হিন্দু এই বিজেপি নেতার নামই হয়ে গেছে ‘বুলডোজার বাবা’। তার নির্বাচনী প্রচারে ব্যাপক বুলডোজারের উপস্থিতিতে এই নামে তাকে ডাকা শুরু হয়েছিল। পরে তিনি তার শাসনের প্রতীক হিসেবে নিজেই বেছে নেন বুলডোজার। সমালোচনার মধ্যেও তার সেই বুলডোজার এখনও চলছে উত্তর প্রদেশে।

সেই বুলডোজার এবার দৃশ্যপটে এল মুহাম্মদ ইউনূসের ‘নতুন’ বাংলাদেশে; স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিজড়ানো ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি গুঁড়িয়ে দিতে। যোগী আদিত্যনাথের বিভিন্ন সমাবেশে যেমন বুলডোজারের ব্যানার থাকে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙার কর্মসূচিই দেওয়া হলো ‘বুলডোজার মিছিল’।

ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তার প্রচারে বুলডোজার ব্যবহার করে আসছেন।

বুধবার রাতে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ভবনের পাশাপাশি বুলডোজার চলেছে খুলনায় বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসেরের বাড়িতে, কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুব-উল আলম হানিফের বাড়িতে। বুলডোজার না চললেও ভাংচুর হয়েছে সিলেট ও চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর মুরালে। ঢাকার ধানমণ্ডিতে শেখ হাসিনার স্বামীর বাড়ি সুধা সদনেও আগুন দেওয়া হয়।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পতনের পর এই সব স্থাপনায় ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ চলেছিল। তার ঠিক ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার পর যখন ভারতে থাকা শেখ হাসিনার ছাত্রলীগের আয়োজনে বুধবার রাত ৯টায় লাইভে এসে ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা আসে, তখনই বুলডোজার কর্মসূচি দেওয়া হয় ঢাকায়।

জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা শেখ হাসিনার ভাষণ দেবেন শুনে প্রথমে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে প্ল্যাটফর্মটির আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ফেইসবুকে লেখেন- “হাসিনাকে বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ দেওয়াকে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী জনগণের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ হিসেবে দেখি।” সন্ধ্যায় তিনি আবার লেখেন- “আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।”

বুলডোজার নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবন ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়ে ফেইসবুকে ভিডিও বার্তা দেন পিনাকী ভট্টচার্য।

তাদের সেই কর্মসূচিকে ‘বুলডোজার মিছিলে’ রূপ দেন ফ্রান্স প্রবাসী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য। তিনি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “যে মুহূর্তে সে (শেখ হাসিনা) বক্তব্য দেওয়া শুরু করবে, সেই মুহূর্তে আপনার দলে দলে আসবেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে, বুলডোজার নিয়ে আসবেন।” তারপর বুলডোজার মিছিলের ফটোকার্ড ছড়িয়ে পড়ে ফেইসবুকে।

এমন দিনে এই কর্মসূচি পালিত হলো, ১২ বছর আগে এই দিনেই শাহবাগে গণজাগরণ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। সেই আন্দোলনে পিনাকীও সক্রিয় ছিলেন, যদিও পরে অবস্থান বদলান তিনি। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় হওয়ার পর শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ। তা পরে শাহবাগ আন্দোলনে রূপ নেয়। সেই আন্দোলনের চাপে আইন সংশোধনের পর রাষ্ট্রপক্ষও আপিলের সুযোগ পায়। আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পর ২০১৮ সালে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছিল এই জামায়াত নেতাকে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার সময় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই বিচার শুরুর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের অধিকাংশ শীর্ষনেতার দণ্ড হয়। গত আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার তিন দিন আগে জামায়াতকে নিষিদ্ধও করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এরপর জামায়াতকে এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ গেছে অদৃশ্য হয়ে।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই বুধবার বঙ্গবন্ধু ভবন, যেটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছিল, তা আবার আক্রান্ত হয়। গত বছরের ৫ আগস্টে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই ভবনে পুনরায় আক্রমণ নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

হাসনাত তো বলেছেনই, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে ‘ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি’ থেকে মুক্ত করা। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নিতে আসা একজন বলেন, “বুলডোজার দিয়ে আমরা আজ স্বৈরাচারের চিহ্ন মুছে দেব।”

ওদিকে ফ্রান্স থেকে পিনাকী ফেইসবুকে আহ্বান জানান- “বুলডোজার ঢুকছে ৩২ নম্বরে। নির্মাণ শ্রমিক ভাইয়েরা আসুন যে যেইখানে আছেন আসুন। কাজ শেষ হলে একটা বেড়া দিবেন। একটা সাইনবোর্ড লাগাবেন। ওইখানে ৫ মে ২০১৩’র শহীদদের স্মৃতিতে একটা মসজিদ হবে। আলেমদের সাহায্য নিবেন কীভাবে মসজিদ নির্মাণ করা হবে।”

রাত সাড়ে ১০টায় তিনি এই আহ্বান জানানোর দুই ঘণ্টা আগেই বঙ্গবন্ধু ভবনে তাণ্ডব শুরুর খবর আসে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে। প্রথম আলো লিখেছে, রাত ৮টার দিকে কয়েকশ বিক্ষোভকারী ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা বঙ্গবন্ধু ভবনের ফটক ভেঙে ফেলে ভেতরে ঢুকে শুরু করেন ভাঙচুর।

বঙ্গবন্ধু ভবনের দোতলায়, তিন তলায় উঠে পড়ে বুধবার রাতে ব্যাপক ভাংচুর হয়।

তবে সাড়ে ১০টার আগে বুলডোজার সেখানে যায়নি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, রাত পৌনে ১১টার দিকে সেখানে বুলডোজার-ক্রেন পৌঁছায়। উল্লাসধ্বনি আর স্লোগানের মধ্যে সেটি মূল সড়ক থেকে ৩২ নম্বরের সড়কে ঢোকে। এসময় বুলডোজারের ওপরে উঠে স্লোগান দিতে থাকেন অনেকে।

কালবেলা জানিয়েছে, বিক্ষোভ শুরুর পর একদল সেনাসদস্য সেখানে গিয়েছিলেন। তাদের বাধার কারণে বুলডোজার বাড়ির ভেতরে ঢোকাতে দেরি হয়েছিল।

এই সময় ওই এলাকায় রাস্তার ওপর দুটো পুলিশ ভ্যান ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোনো অবস্থান দেখা যায়নি বলে জানিয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু ভবনের তৃতীয় তলা ও দোতলায় অনেক মানুষ উঠে পড়েন। তাদের কেউ বাড়ির দেয়াল ভাঙছিলেন, কেউ হাতুড়ি বা লাঠি দিয়ে ভাঙছিলেন বাড়িটির সীমানা প্রাচীর। জানালার গ্রিল, কাঠ এসবও নিতে দেখা গেছে অনেককে।

গত ৫ আগস্ট এই বাড়িতে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের সময় ব্যাপক লুটপাট হয়, ভবনের লিফটও খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাংচুরের সময় ৩২ নম্বর বাড়ির উল্টোপাশে লেকের সেতুর পাশের খোলা জায়গায় প্রজেক্টরে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ধানমণ্ডি থানা শাখা। সেখানে স্পিকারে ঘোষণা দেওয়া হয়, “আমরা আন্দোলনের প্রামাণ্যচিত্র দেখাচ্ছি। আপনাদের যাদের ভাঙার আছে, তারা সামনে গিয়ে ভেঙে আসেন। এখানে যারা প্রামাণ্যচিত্র দেখতে চায়, তাদের সুযোগ দেন।”

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের কাল পর্বের ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের নানা স্মৃতি জড়ানো।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা ওঠার পর এই বাড়িতেও তা তোলা হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষণাও এসেছিল এই বাড়ি থেকেই। আবার ১৯৭৫ সালে এই বাড়িতেই সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে।

কালের সাক্ষী এই বাড়িটি আক্রান্ত হওয়ার পর গত বছরের ৮ আগস্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আহ্বান জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর সংস্কার করেই শুরু হোক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পথ চলা। বাড়িটিকে আগের রূপে ফিরিয়ে এনে, নানা ছবি বা অবশিষ্ট স্মৃতিস্মারক দিয়ে জাদুঘর ফের চালুর তাগিদ দিয়েছিলেন তিনি।

এক ফেইসবুক পোস্টে ফারুকী লিখেছিলেন, “আমি মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কাজ হবে ৩২ নম্বরের বাড়ির পুনর্বাসনের কাজ শুরু করা। এই বাড়িকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং এ বাড়ি সম্পর্কিত বিভিন্ন ছবি, স্মৃতিস্মারক যা যা পাওয়া যায় তা দিয়ে জাদুঘর আবার চালু করা।”

সেই ফারুকী এখন ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বে। এবং তার সামনেই পুনরায় আক্রান্ত হলো বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি।

পাকিস্তান আমলে ১৯৫৭ সালে শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী থাকাকালে ধানমণ্ডির এই ১ বিঘা জমি তাকে বরাদ্দ দেয় সরকার। সেই জমিতে দুই কক্ষের একটি একতলা ভবন করে ১৯৬১ সালে পরিবার নিয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৬৬ সালে বাড়িটি দোতলা করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাড়িটি দখল করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু পরিবারকে ধানমণ্ডিরই অন্য একটি বাড়িতে বন্দি রেখেছিল। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর পরিবার নিয়ে আবার এই বাড়িতে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি সরকারি বাড়িতে যাননি।

ধানমণ্ডির পুরনো ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটির কাগজে কলমে নম্বর এখন ১০, সড়ক নম্বরও বদলে হয়েছে ১১। তবে এখনও সবাই ৩২ নম্বর নামেই চেনে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছর পর ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে দেখেন, জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছে, কেননা বাড়ি তৈরির জন্য হাউস বিল্ডিংয় ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করে যেতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। সেই ঋণ পরিশোধ করে ওই বছরই বাড়ির মালিকানা ফিরে পান শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিভিন্ন দিবসে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ভরে উঠত ফুলে ফুলে।

১৯৯৪ সালে বাড়িটি বঙ্গবন্ধু জাদুঘর হিসাবে যাত্রা শুরু করে। তখন এটি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০১১ সালে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে জাদুঘরটি সম্প্রসারিত করা হয়।

বুধবার শেখ হাসিনার যে কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুনরায় আক্রমণ হলো, সেই ভাষণে নিজের স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়ি নিয়েও কথা বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “দেশের স্বাধীনতা কয়েকজন বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলবে, এই শক্তি তাদের হয়নি। তারা একটি দালান ভেঙে ফেলতে পারবে, কিন্তু ইতিহাস মুছতে পারবে না।

“বাড়িটার কী অপরাধ? ওই বাড়িটাকে কেন এত ভয়? আমি দেশের মানুষের কাছে আজ বিচার চাই।”

“ইতিহাস কিন্তু প্রতিশোধ নেয়,” একথাও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।

সেই সঙ্গে বলেন, “দেশের মানুষের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তারা ফ্যাসিবাদী, না যারা মানুষকে উন্নত জীবন দেয়, তারা ফ্যাসিবাদী? এটা দেশের জনগণই বিচার করবে।”

আরও পড়ুন