বিজয়ের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু নির্বাসনে

গতবছরও এরকম শ্রদ্ধার ফুলে ঢাকা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি!
গতবছরও এরকম শ্রদ্ধার ফুলে ঢাকা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি!

‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’- রাত পোহানোর পর বাংলাদেশে বিজয়ের উৎসব শুরু হলেও এবার শোনা গেল না গানটি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এবার বদলেছে অনেক কিছুই; তাতে হারিয়ে গেছে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম, তার অবদান।

২০২৪ সালের বিজয় দিবসে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থেকে তো বঙ্গবন্ধুর নাম হারিয়ে গেছেই; রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দিবসের বাণীতে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি কাদের হারিয়ে এই বিজয় এলো, সেই পাকিস্তানের নামটি।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পাকিস্তান হলেও বাঙালির শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটেনি। পাকিস্তানি শাসকদের প্রধম আঘাত আসে বাংলা ভাষার ওপর; ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়ে সেই ভাষার অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছিল।

তারপর দীর্ঘ অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাঙালির মুখপাত্র হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান; পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে ৫৬ বছরের জীবনের ১৪ বছরই কারাগারে কাটাতে হয়েছিল তাকে। পরম ভালোবাসায় তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয় বাঙালি।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের মহাকাব্যিক এক ভাষণে বাঙালিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন বঙ্গবন্ধু; এরপর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দিয়ে যান স্বাধীনতার ঘোষণা।

বঙ্গবন্ধুর ডাকেই মুক্তিযুদ্ধে নেমেছিল জনতা; নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণের এবং দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আসে বিজয়। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় লাল-সবুজ পতাকার বাংলাদেশ।

এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু; তার শাসনকাল নিয়ে নানা সমালোচনাও ওঠে।

তারমধ্যেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের অভ্যুত্থানে সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

তখন স্বাধীনতার বিপরীত স্রোতে বাংলাদেশের চলার শুরুটা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বাবার গড়া দল আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তারা বঙ্গবন্ধুর নাম নিষিদ্ধই করে রেখেছিল।

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছর সরকার পরিচালনার পর ২০০৯ সালে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট তার টানা দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘটে।

প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এখনও সেখানেই রয়েছেন তিনি। তার দলের নেতারা কেউ কারাগারে, কেউ পালিয়ে। ৫ আগস্টের পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন শাখা অফিসগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য কোনও কার্যক্রমও নেই।

অভ্যুত্থানের পর গঠিত নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শেখ হাসিনার ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের’ অবশেষ উপড়ে ফেলতে তৎপর। তার ধারাবাহিকতায় এবারের বিজয়ি দিবস উদযাপনে কোথাও নেই বঙ্গবন্ধুর স্থান।

বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বাণীতে সাদামাটাভাবে বলা হয়েছে- “আজ ১৬ই ডিসেম্বর, বিজয় দিবস। এ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গৌরবময় এবং স্মরণীয় দিন । ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীনতার স্বাদ এবং জাতি হিসেবে নিজস্ব পরিচিতি। লাখ লাখ শহিদের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়ে যাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।”

বাণীতে কোথাও ছিল না কীভাবে এই স্বাধীনতা সংগ্রাম সংগঠিত হলো কিংবা কার বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলোদেশ স্বাধীন হলো।

আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হলেও রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বাণীতেও ছিল না স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নাম; ছিল না পাকিস্তানি বাহিনীর কথাও।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবাদর্শে পরিচালিত করতে চাইছে বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ।

বিজয় দিবস উপলক্ষে দলটি এক বিবৃতিতে বলেছে, “স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা ও আদর্শ আজ সংকটের সম্মুখীন। বাংলাদেশের মানচিত্র ও জাতির পতাকা খামচে ধরেছে পুরোনো শকুনেরা।”

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় বসার পর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, সংবিধান দিবস এবং জাতীয় শোক দিবস রাষ্ট্রীয় আচার থেকে বাদ দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগানের স্বীকৃতি দেওয়া হাই কোর্টের রায় স্থগিতের কথাও বলা হয় বিবৃতিতে।

‘ফ্যাসিবাদী’ তকমা নিয়ে ক্ষমতাহারা আওয়ামী লীগ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকেই ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যায়িত করেছে।

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোর আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণের তালিকা থেকে মুছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি দেখাচ্ছেন, তাকে সামনে রেখেই শেখ হাসিনা ‘ফ্যাসিবাদী’ শাসন জারি রেখেছিল। পাশাপাশি বাকশালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার কথাও বলেন তারা।

দলীয়করণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে তাদের নিজেদের করে রেখেছিল অভিযোগ করে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা এই ঘোষণাও দিয়েছেন, আওয়ামী লীগকে কোনও ধরনের কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না।

এদিকে আওয়ামী লীগের শাসকালের পুরোটা সময় কোণঠাসা বিএনপি হাঁফ ছেড়ে উঠে এখন আবার পুরনো বিতর্ক জাগিয়ে তুলতে চাইছে।

বিজয় দিবসের বাণীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাকে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার বাণীতে পাকিস্তানি বাহিনীর কথা না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়ার ছেলে তারেকের বাণীতে পাকিস্তানকে হারানোর কথা ছিল।

কয়েক বছর আগে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট বলেও দাবি করেছিলেন তারেক। তখন তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা উঠেছিল। পরে বঙ্গবন্ধুর বাইরে কাউকে স্বাধীনতার ঘোষক না বলার নির্দেশনা আদালত থেকেও আসে।

রাজনৈতিক পালাবদলের পর রাষ্ট্রীয় আয়োজন থেকে বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসনে পাঠানোর পর এখন স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে পুরনো বিতর্ক আবার মোকাবেলায় নামতে হচ্ছে কোণঠাসা হয়ে পড়া আওয়ামী লীগকে।

সম্পর্কিত সংবাদ
একই রাষ্ট্রপতি, একই দিবস; অথচ বাণীতে কত ফারাক

আরও পড়ুন