বিজয়ের আয়োজনে কোথাও নেই বঙ্গবন্ধু

২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর সর্বশেষ এরকম শ্রদ্ধার ফুলে ঢাকা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। ফাইল ছবি
২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর সর্বশেষ এরকম শ্রদ্ধার ফুলে ঢাকা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। ফাইল ছবি

‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’- রাত পোহানোর পর বাংলাদেশে বিজয়ের উৎসব শুরু হলেও এবারও শোনা গেল না গানটি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বদলেছে অনেক কিছুই; তাতে হারিয়ে গেছে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম, তার অবদান।

২০২৫ সালের বিজয় দিবসে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থেকে তো বঙ্গবন্ধুর নাম হারিয়ে গেছেই; রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের দিবসের বাণীতে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি কাদের হারিয়ে এলো এই বিজয়, সেই পাকিস্তানের নামটি।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পাকিস্তান হলেও বাঙালির শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটেনি। পাকিস্তানি শাসকদের প্রধম আঘাত আসে বাংলা ভাষার ওপর; ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়ে সেই ভাষার অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছিল।

তারপর দীর্ঘ অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাঙালির মুখপাত্র হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান; পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে ৫৬ বছরের জীবনের ১৪ বছরই কারাগারে কাটাতে হয়েছিল তাকে। পরম ভালোবাসায় তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয় বাঙালি।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের মহাকাব্যিক এক ভাষণে বাঙালিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন বঙ্গবন্ধু; এরপর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দিয়ে যান স্বাধীনতার ঘোষণা।

বঙ্গবন্ধুর ডাকেই মুক্তিযুদ্ধে নেমেছিল জনতা; নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণের এবং দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আসে বিজয়। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় লাল-সবুজ পতাকার বাংলাদেশ।

এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু; তার শাসনকাল নিয়ে নানা সমালোচনাও ওঠে।

তারমধ্যেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের অভ্যুত্থানে সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

তখন স্বাধীনতার বিপরীত স্রোতে বাংলাদেশের চলার শুরুটা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বাবার গড়া দল আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তারা বঙ্গবন্ধুর নাম নিষিদ্ধই করে রেখেছিল।

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছর সরকার পরিচালনার পর ২০০৯ সালে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট তার টানা দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘটে।

প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এখনও সেখানেই রয়েছেন তিনি। তার দলের নেতারা কেউ কারাগারে, কেউ পালিয়ে। ৫ আগস্টের পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন শাখা অফিসগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য কোনও কার্যক্রমও নেই।

অভ্যুত্থানের পর গঠিত নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শেখ হাসিনার ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের’ অবশেষ উপড়ে ফেলতে তৎপর। তার ধারাবাহিকতায় এবারের বিজয়ি দিবস উদযাপনে কোথাও নেই বঙ্গবন্ধুর স্থান।

বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের বাণীতে সাদামাটাভাবে বলা হয়েছে- “১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে এই দিনে আমরা পাই কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের স্বাদ। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাই একটি স্বাধীন জাতিসত্তা, আর এই লাল-সবুজের পতাকা।”

বাণীতে কোথাও ছিল না কীভাবে এই স্বাধীনতা সংগ্রাম সংগঠিত হলো কিংবা যাদের কার বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।

এমনকি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ কিংবা বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা কোথাও উল্লেখ নেই বাণীতে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হলেও রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বাণীতেও ছিল না স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নাম; ছিল না পাকিস্তানি বাহিনীর কথাও।

প্রধান উপদেষ্টার মতই গৎবাঁধা বাক্যের বাইরে বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধ ছিল না, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য। বিগত পাঁচ দশকের পথচলায় জনগণের পূর্ণ রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক মুক্তি এখনও অর্জিত হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়তে নতুন আশা জাগিয়েছে।”

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবাদর্শে পরিচালিত করতে চাইছে বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ।

বিজয় দিবস উপলক্ষে দলটি এক বিবৃতিতে বলেছে, “স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা ও আদর্শ আজ সংকটের সম্মুখীন। বাংলাদেশের মানচিত্র ও জাতির পতাকা খামচে ধরেছে পুরোনো শকুনেরা।”

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, “১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। দীর্ঘ নয়মাস আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে সর্ব্বোচ্চ ত্যাগের পথ ধরে জাতি বিজয় অর্জন করে। দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ জাতীয় চারনেতাসহ মুজিব নগর সরকারের সকল সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ এবং ৩০ লাখ শহীদ ও অগণিত নির্যাতিত মা-বোনদের।”

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ৭১ এর পরাজিত শক্তি আবারও উদ্যত হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাণীতে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় বসার পর সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মুছে ফেলার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “পাঁচই আগস্ট প্রথমেই আক্রমণ হল বঙ্গবন্ধুর উপর। বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি বত্রিশের বাড়িতে আগুন দেয়া হল; এখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সারাদেশ জুড়ে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেয়া হলো, লুট হলো স্বাধীনতা জাদুঘর, এমনকি বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভ পর্যন্ত রক্ষা পেল না। গত প্রায় ১৭ মাস ধরে নৈরাজ্য চলছে দেশজুড়ে। এর প্রধান লক্ষ্যবস্তু মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা শারীরিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, জাতির পিতার বিরুদ্ধে চলছে কুৎসা, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে অবনমন করার জন্য হাজির করা হচ্ছে মনগড়া ন্যারেটিভ। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মকে বলা হচ্ছে- ‘নিকৃষ্টতম প্রজন্ম’। দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের দেয়া হয়েছে মুক্তি।”

‘ফ্যাসিবাদী’ তকমা নিয়ে ক্ষমতাহারা আওয়ামী লীগ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকেই ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যায়িত করেছে।

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোর আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণের তালিকা থেকে মুছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি দেখাচ্ছেন, তাকে সামনে রেখেই শেখ হাসিনা ‘ফ্যাসিবাদী’ শাসন জারি রেখেছিল। পাশাপাশি বাকশালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার কথাও বলেন তারা।

দলীয়করণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে তাদের নিজেদের করে রেখেছিল অভিযোগ করে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা এই ঘোষণাও দিয়েছেন, আওয়ামী লীগকে কোনও ধরনের কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না।

এদিকে আওয়ামী লীগের শাসকালের পুরোটা সময় কোণঠাসা বিএনপি হাঁফ ছেড়ে উঠে এখন আবার পুরনো বিতর্ক জাগিয়ে তুলতে চাইছে।

বিজয় দিবসের বাণীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাকে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার বাণীতে পাকিস্তানি বাহিনীর কথা না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়ার ছেলে তারেকের বাণীতে পাকিস্তানকে হারানোর কথা ছিল।

কয়েক বছর আগে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট বলেও দাবি করেছিলেন তারেক। তখন তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা উঠেছিল। পরে বঙ্গবন্ধুর বাইরে কাউকে স্বাধীনতার ঘোষক না বলার নির্দেশনা আদালত থেকেও আসে।

রাজনৈতিক পালাবদলের পর রাষ্ট্রীয় আয়োজন থেকে বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসনে পাঠানোর পর এখন স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে পুরনো বিতর্ক আবার মোকাবেলায় নামতে হচ্ছে কোণঠাসা হয়ে পড়া আওয়ামী লীগকে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads