অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাড়ছে। এসব ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার বা আইনের আওতায় আনা হয়নি বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
সংস্থাটি বলছে, গত পাঁচ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। এদের মধ্যে যৌথ বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ১০ জন। হেফাজতে যারা মারা গেছেন তারা ক্রসফায়ার এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন।
শুধু জানুয়ারি মাসে মারা গেছেন পাঁচ জন। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে তিনজনের বেশি মানুষের হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে।
২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকারের সাত মাসসহ এক বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মোট ২১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে দু’জনের কম মৃত্যু হয়েছিল।
গত পাঁচ মাসে যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন তার হলেন- গোপালগঞ্জের ইলাহি শিকদার , নারায়ণগঞ্জেক সৈয়দ নুরুল কবির, গাইবন্ধার শফিকুল ইসলাম, ময়মনসিংহের সহিদুল ইসলাম, সাভারের কাওসার হোসেন ও চম্পা খাতুন, চট্টগ্রামের মো. শরীফ, কিশোরগঞ্জের হৃদয় রবি দাস, যশোরের আতিক হাসান সরদার,কক্সবাজারের মোসলেম উদ্দিন, কিশোরগঞ্জের ইয়াসিন মিয়া, নোয়াখালীর আব্দুর রহমান, শরিয়তপুরের মিলন বেপারী এবং কুমিল্লার তৌহিদুল ইসলাম।
এদের মধ্যে একমাত্র কুমিল্লার তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনা নিয়েই ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। বাকিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তেমন আলোচনায় আসেনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সভাপতি সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ডয়চে ভেলে’কে বলেন, “এবার যুবদল নেতা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর, আইএসপিআর বিবৃতি দিচ্ছে। কিন্তু এই সরকারের আমলে আরো হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো নিয়ে সরকার কোনো কথা বলেনি।
“আমরা এখন পর্যন্ত এইসব ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার বা আইনের আওতায় আনতে দেখিনি। আর গত ১৮ বছরে তো আরো অনেক হত্যা হয়েছে। সেগুলোও বিচারের আওতায় আনা হয়নি।”
তিনি বলেন, “এই সরকার যদি হেফাজতে মৃত্যু বন্ধ এবং আইন শৃঙ্খলার উন্নতি না করতে পারে তাহলে তাদের প্রতি মানুষের আস্থা আরো কমবে। এখন পর্যন্ত যা দেখছি তা হতাশাজনক। আর এসব কথা বললেই বলা হয় স্বৈরাচারের দোসর।”
“সরকারের কাজ শুধু বিবৃতি বা নিন্দা জানানো নয়, তাদের কাজ ব্যবস্থা নেয়া । আমরা সেই ব্যবস্থা দেখতে চাই,” বলেন তিনি।
মানবাধিকার কর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান জার্মান রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলে’কে বলেন, “তথ্য উপাত্ত যা পাওয়া যাচ্ছে তাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাড়ছে। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এই সরকারের আমলে আমরা এটা আশা করিনি। প্রতিটি ঘটনার দ্রত তদন্ত ও বিচার করতে হবে।”
পুলিশের কাজ সেনাবাহিনীকে দিয়ে করানোতে সংকট আরো বাড়ছে বলে তার অভিমত।
নূর খান বলেন, “সেনাবাহিনী দিয়ে কাজ হবে না। তারা সিভিলিয়ানদের কীভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় সেই সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয়। তারা যে শুধু বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িয়েছে, তা নয়। তাদের বিরুদ্ধে এখন ডাকাতি, ছিনতাই, বাড়ি দখল করা, মানুষ পাচার করার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠছে।”
কুমিল্লায় তৌহিদুল ইসলাম নিহতের ঘটনায় সেনা আইনে ব্যবস্থা নেয়ার বিরোধিতা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান।
ডয়চে ভেলে’কে তিনি বলেন, “ওই ঘটনায় যে শুধু সেনা সদস্যরাই জড়িত তা তারা নিশ্চিত হলেন কীভাবে? আইনেই বলা আছে যেকোনো বাহিনীই জড়িত থাকুক না কেন, হত্যা বা ধর্ষণের মতো অপরাধের বিচার প্রচলিত আইনে সিভিল কোর্টে হতে হবে। তা না হলে ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দেহ আছে।”
ইশরাত হাসান নিজেই তাই ওই ঘটনায় কুমিল্লার এসপি বরাবর হেফাজকে মুত্যু নিবারণ আইনে মামলা করার আবেদন করেছেন।
তিনি বলেন, “ওই আইনেই তৃতীয় পক্ষের মামলা সুযোগ আছে। আর দ্রুত মামলা করতে হয়। তাই আমি মামলার আবেদন করেছি।”
নূর খানও সেনা আইনে ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, “তারা অপরাধ করেছে সিভিল দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এবং সিভিলিয়ানদের ওপরে। তাই সামরিক আদালতে বিচারের নামে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হতে পারে। আর যে ধরনের অপরাধ তা সিভিল আদালতেই বিচারের বিধান আছে। তা না করলে ঘটনাটা আমরা জানতে পারব না।”
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও পরিস্থিতি উন্নয়নের নামে ২০০৪ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব গঠন করে। কিন্তু পরে এ বাহিনী ‘ক্রসফায়ার’– এর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকেই সন্ত্রাস দমনের সবচেয়ে সহজ কৌশল হিসেবে বেছে নেয়। র্যাব গঠনের বছর না ঘুরতেই ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হওয়ার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। পরে তা আরও বাড়ে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালে। ওই বছর ৪১২ জন এ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে পুলিশের হাতে, ২১৬টি। র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন ১৩৫ জন। অন্যান্য বাহিনীর হাতে এ ধরনের হত্যার ঘটনা ঘটে ১৭টি।
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
ওই বছর দেশে ১৮৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরের বছরই হত্যার ঘটনা ঘটে ৫১টি।