বাঁচার আকুতি ইরান প্রবাসী বাংলাদেশিদের

ইসরায়েলি হামলার পর ধোঁয়া উড়ছে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সদর দপ্তর থেকে; ওই এলাকাতেই বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা থাকতেন।
ইসরায়েলি হামলার পর ধোঁয়া উড়ছে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সদর দপ্তর থেকে; ওই এলাকাতেই বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা থাকতেন।

এক সময় বাংলাদেশের চিকিৎসকদের বড় একটি অংশ ইরানে কাজ করতেন। সেটা প্রায় চার দশক আগে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়ও। এখন খুব বেশি বাংলাদেশি ইরানে নেই। তবে যে দুই হাজারের মতো আছেন, ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ শুরুর পর তারা রয়েছেন আতঙ্কে।

গত শুক্রবার বিমান হামলা শুরুর পর ইরানে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ছে, তাতে দেশটির শীর্ষ স্থানীয় বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন।

তারপর ইরানও পাল্টা হামলা চালানোর পর থেকে দুই পক্ষেই প্রাণক্ষয় হচ্ছে। এরমধ্যে ইসরায়েলের মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার ইরানের রাজধানী তেহরান খালি করতে বলেছেন।

তাতে তেহরান থেকে ইরানিদের পালানোর হিড়িক পড়েছে। জ্বালানি তেলের দেশ ইরানেরই পেট্রোল পাম্পে দেখা যাচ্ছে জ্বালানি তেলের সঙ্কট।

ভিনদেশী বাংলাদেশিরা পড়েছেন বিপদে; তারা কী করবেন, তা বুঝে উঠতে পারছেন না। এর মধ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আবাসেও ইসরায়েলি গোলা এসে পড়েছে। ফলে অন্য বাংলাদেশিরা রয়েছেন উৎকণ্ঠায়।

সরকারি হিসেবে বর্তমানে ইরানে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা২ হাজার। তার মধ্যে ৪০০ জন তেহরানে থাকেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাদের অনেকে তেহরান থেকে বের হওয়ার জন্য বাংলাদেশ মিশনে যোগাযোগ করছেন।

তেহরানে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ওয়ালিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “অনেকেই ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করছেন; বলছেন- এখানকার পরিস্থিতি ভালো না ভাই, আমাদের বাঁচান।”

তেহরানের বাইরেও কয়েকটি শহরে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে। সেসব শহর থেকেও অনেকে যোগাযোগ করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন বলে ওয়ালিদ জানান।

তিনি বলেন, “যেমন, বন্দর আব্বাসে হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেখানকার পরিস্থিতিও খারাপ। ফলে ওই এলাকা থেকেও অনেকে ফোন দিচ্ছেন, আর কান্নাকাটি করছেন। এই আর্তনাদ আসলে সহ্য করা যায় না।”

বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০ জন সম্প্রতি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তেহরানে গিয়েছিলেন। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তারা আটকা পড়েছেন।

বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে যে প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে তা হলো ইসরায়েলের আসল লক্ষ্য আসলে কী?
বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে যে প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে তা হলো ইসরায়েলের আসল লক্ষ্য আসলে কী?

তেহরানের বিভিন্ন এলাকায় থাকছিলেন তারা। গত শুক্রবার সংঘাত শুরুর পর তাদের হাসপাতাল এলাকায় অবস্থান করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল দূতাবাস থেকে।

ওয়ালিদ বলেন, “হাসপাতাল নিরাপদ হবে ভেবেই আমরা এই পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু গত পরশুদিন হাসপাতালেই আক্রমণ হয়েছে। এরপর থেকে এই রোগীদের সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। আমি তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। কীভাবে তাদেরকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া যায়, সেই চেষ্টাও চলছে।”

বেড়াতে গিয়ে ইরানে আটকা পড়েছেন বাংলাদেশি চিকিৎসক ইকরাম আর আজিজুর রহমান। তার স্ত্রী ইরানি। গত মে মাসে তারা ইরান গিয়েছিলেন, বাংলাদেশে ফেরার কথা ছিল গত ১৫ জুন।

“কিন্তু এরমধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় ১৫ তারিখে ফেরা সম্ভব হয়নি। কবে ফিরতে পারব, সেটাও বুঝতে পারছি না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ডা.ইকরাম।

প্রবাসীরা দূতাবাসের কাছে সমাধান চাইলেও সোমবার তেহরানে ইসরায়েলের হামলায় আক্রান্ত হয় বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত কর্মকর্তাদের বাসভবন। তাতে ওয়ালিদ ইসলামের বাসা গুঁড়িয়ে যায়, ওই সময় তিনি বাসায় না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

তেহরানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা মূলত জর্ডান নামের একটি এলাকায় থাকেন। ওই এলাকায় ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। সেখানে সোমবার ঘোষণা দিয়ে হামলা চালায় ইসরায়েল।

ওয়ালিদ বলেন, “আমাদের আশপাশে এখন আর কিছুই নাই। কেবল কূটনীতিকদের কয়েকটি বাড়ি টিকে আছে, কিন্তু আশপাশে কিছুই নাই।”

সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা

ইসরায়েলি হামলার পর বাংলাদেশ মিশনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বাংলাদেশি নাগরিকদের সবাইকে জর্ডান এলাকা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় ঢাকা থেকে। এরপর তেহরানে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস কমপ্লেক্স ছেড়ে যান সেখানকার কর্মীরা।

তারা এখন তেহরানেই অন্য এলাকায় থাকলেও ইসরায়েলি হামলার ব্যাপ্তি বাড়তে থাকায় এখন নাগরিকদের তেহরানের বাইরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিক মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন, যারা তেহরানে আছে। তারা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে আছে। তাদের এবং আমাদের দূতাবাসে যারা কাজ করছেন, তাদের জন্য এখন কাজ করছি, যাতে এরা নিরাপদে থাকতে পারে।”

তেহরানে থাকা বাংলাদেশিরা এখনও অক্ষত রয়েছেন বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

জরুরি প্রয়োজনে তারা যেন যোগাযোগ করতে পারেন, সেজন্য হটলাইন চালু করেছে তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাস। সেগুলোর নম্বর হলো- + ৯৮৯৯০৮৫৭৭৩৬৮ ও + ৯৮৯১২২০৬৫৭৪৫। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একটি হললাইন চালু করেছে, নম্বর হলো + ৮৮০১৭১২০১২৮৪৭।

ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব বেশ পুরনো। দেশটিতে রয়েছে বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক। ছবি: ইরান ও বাংলাদেশের পতাকা।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “ইতোমধ্যে প্রায় ১০০ জন দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হটলাইনে যোগাযোগ করে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।”

অন্য নাগরিকদের সঙ্গে দূতাবাসের ৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

তাদের কোথায় সরিয়ে নেওয়া হবে- প্রশ্নে ওয়ালিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আপাতত সবাইকে ভারামিনে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের তেহরানের পাশে সাবেতে রাখার ব্যবস্থা করছি।”

ভারামিন শহরও তেহরানেই অবস্থিত। ফলে পরবর্তীকালে সেখানেও হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নাগরিকদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এখন সেটাও কঠিন।

দূতবাস কর্মকর্তা ওয়ালিদ বলেন, “এখন সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ ইরানে বিমান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে যদি একদিনের জন্যও যুদ্ধবিরতি দেয়, তখনই আমরা সবাইকে ইরানের বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করব।”

কিন্তু কতদিন নাগাদ সেই সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে, তা এখন অনিশ্চিত। ফলে যুদ্ধের মধ্যে শঙ্কা নিয়েই ইরানে থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশিদের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন