বাংলাদেশের অর্থনীতি শুধু বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখে নয়, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চলমান সহিংসতায় আরও গভীর সঙ্কটে নিপতিত। বিশ্ব ব্যাংক তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৩ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে, যা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস থেকেও কম।
বিশ্ব ব্যাংকের ভাষ্য, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতা এই পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার চালানো হামলা দেশের বিনিয়োগ পরিবেশকে নাজুক করে তুলেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর ওপর দমনপীড়ন, নির্বাচনী স্বচ্ছতায় ঘাটতি এবং সহিংস আন্দোলনের জেরে দেশে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের সহিংসতা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, বরং বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাসের অন্যতম কারণ। দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তা এড়াতে নতুন প্রকল্পে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনে।
বিশ্ব ব্যাংকের ‘সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিও এসময়ের মধ্যে গড়ে ১০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এর ফলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠবে, যা তৈরি করতে পারে সামাজিক অস্থিরতা।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকের তৃতীয় দিনে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ২১ এপ্রিল বৈঠকটি শুরু হয়েছে; শেষ হবে ২৬ এপ্রিল। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বৈঠকে অংশ নিচ্ছে।

তবে সরকারিভাবে এখনো রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবকে খাটো করে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫.২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা আগের ৬.৭৫ শতাংশ লক্ষ্য থেকে কম। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাস্তবতা আরও কঠিন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.২২ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তা আরও কমে ১.৯৬ শতাংশে নেমে আসে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। তবে বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সামাজিক সহনশীলতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ঘাটতি এই পতনের অন্যতম চালক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার বলেন, “এখনই সময় নির্দিষ্ট কিছু সংস্কার উদ্যোগ নেওয়ার, যাতে অর্থনীতির সহনশীলতা বাড়ে এবং প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করা যায়।”
তিনি বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা, কৃষিকে আধুনিকায়ন এবং বাণিজ্য অবাধ করারও পরামর্শ দিয়েছেন।
কিন্তু অনেক অর্থনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের অবসান না ঘটালে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন কোনো ভাল ফল আনবে না।
বাংলাদেশকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহনশীল এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য অধরা থেকে যাবে বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত।