জুতা মানেই বাটা, ভারতবর্ষে এক সময় এটাই ছিল কথা। এই অঞ্চলের মানুষের প্রথম জুতা পরার ইতিহাসের সঙ্গে বাটা জড়িত নয়, তবে সাধারণ মানুষের পায়ে জুতা গলানোর ক্ষেত্রে এই নামটিই আগে নিতে হয়।
এই বাটা কে? সেই কথাটিও এক সময় ভারতবর্ষের শিক্ষিতজনদের জানা হয়ে যেত শৈশবেই। চেকস্লোভাকিয়ার এক মুচির ছেলে টমাস বাটার জুতো কোম্পানির মালিক হয়ে যাওয়ার গল্পটি বইয়েও স্থান করে দেয়।
শতবর্ষ পেরিয়ে আসা সেই বাটা হঠাৎ বাংলাদেশে আলোচিত হয়ে উঠল বহুজাতিক এই কোম্পানির কয়েকটি বিক্রয় কেন্দ্রে হামলার পর।
গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে সোমবার ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর ডাকে একদিন বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছিল। বাংলাদেশে সেই বিক্ষোভ থেকে ‘ইসরায়েলি পণ্য’ তকমা নিয়ে বাটার বিক্রয় কেন্দ্রতে হামলা, ভাংচুরের সঙ্গে লুটপাটও চলে, যা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা।
অথচ ইতিহাস ঘেঁটে ইসরায়েলের সঙ্গে বাটার যোগসূত্রের কোনো প্রমাণ মেলে না। তবে বাংলাদেশে যেমন বাটা রয়েছে, তেমনি ইসরায়েলেও রয়েছে। এমনকি ফিলিস্তিনেও রয়েছে বাটা। টমাস বাটা বেঁচে থাকতে ১৯৩১ সালেই খুলেছিলেন প্যালেস্টাইন বাটা শু কোম্পানি লিমিটেড।

ওই একই সময়ে ভারতবর্ষে এশিয়ায় নিজেদের বৃহত্তম কারখানা বসিয়ে জুতা তৈরিতে নামেন বাটা। কলকাতার উপকণ্ঠে যেখানে কারখানা বসিয়েছিলেন, তার নামই হয়ে যায় বাটানগরী।
আর বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধে জড়িয়ে আছে বাটা শু কোম্পানির এক কর্মকর্তার নাম। তিনি হলেন উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড।
ভিনদেশী মুক্তিযোদ্ধা
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য যাদের বিভিন্ন খেতাব দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার, তা অর্জনকারী একমাত্র বিদেশি হলেন বাটা কোম্পানির কর্মকর্তা ওডারল্যান্ড।
জাতিতে তিনি ডাচ, তবে নাগরিক পরিচয়ে অস্ট্রেলিয়ান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তিনি।
পূর্ব পাকিস্তানে বাটা আসে ১৯৬০ সালে। ব্যবসার সম্ভাবনা দেখে তারা ১৯৬২ সালে একটি কারখানা তৈরি করে এখানে। সেই কারখানা পরিচালনায় নির্বাহী পরিচালক হয়ে এসেছিলেন ওডারল্যান্ড ১৯৭০ সালে।
বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে বাটার এক বিজ্ঞাপনী বার্তায় ওডারল্যান্ডকে নিয়ে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে আসার পর পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়ন চোখ এড়ায় না তার। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যখন শুরু হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের ধ্বংসযজ্ঞ, ওডারল্যান্ড তার পক্ষ নির্ধারণ করে ফেলেন। তার ভাষায়, “একাত্তরের মার্চে যখন পাকিস্তানি সৈন্য আর ট্যাংক ঢাকার রাস্তায় নেমে এল, আমি যেন আমার যৌবনের ইউরোপে ফেরত গেলাম।”
ওডারল্যান্ড নিজেও জীবন বিপন্ন করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানিদের বিপক্ষে। তার নেতৃত্বে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। তার পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়।

গাজীপুরের টঙ্গীতে বাটা কারখানায় কর্মরত শ্রমিক মো. আমিন উদ্দিনকে উদ্ধৃত করে বিজ্ঞাপনী বার্তায় বলা হয়, “আমাদের সহকর্মী ও বড় ভাইদের কাছে শুনেছি, বাটার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ওডারল্যান্ডের যাতায়াত ছিল সর্বত্র। সেই সুযোগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ওডারল্যান্ড মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, তথ্য, অস্ত্র, ওষুধ সরবরাহ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রণ কৌশল শিখিয়েছেন। তখন আমাদের বাটার টঙ্গীর কারখানাটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ক্যাম্প। তিনি কর্মীদের যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করতেন।”
এভাবেই ওডারল্যান্ডের হাত ধরে বাটা মিশে যায় বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জন্মযুদ্ধের সঙ্গী এই বিদেশিকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে সরকার।
বাটা বাংলাদেশের মহাব্যবস্থাপক মালিক মেহেদি কবির বলেন, “বাংলাদেশে অনেক দিন কাজ করার ফলে বাটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাটা কিন্তু বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে।”
বাংলাদেশে প্রায় ৬৪ একর জায়গা নিয়ে বাটার ২টি কারখানা। একটি ধামরাইয়ে, আরেকটি টঙ্গীতে। এখানে কাজ করেন ৩ হাজার কর্মী।
বাটানগর দিয়ে ভারতবর্ষে
ভারতবর্ষে বাটা পা রাখে ১৯৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে। হুগলির কোন্নগরে এক বিঘামতো জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয় প্রথম কারখানা।
ভারতের অনলাইন পোর্টাল এই সময়-এ প্রকাশিত এক লেখায় বাটার যাত্রা শুরুর বর্ণনা দেওয়া হয় এভাবে- “১৯৩২ সালের এক রৌদ্রোজ্জ্বল শীতের দিন। ভাসমান হাওড়া ব্রিজের এক কোণে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন এক মাঝবয়সী চেক সাহেব। ব্রিজ দিয়ে যত মানুষ পারাপার করছেন তিনি তাদের পা দুখানি অনুসরণ করছেন।
“এর ঠিক কয়েক দিন আগে ব্যস্ত চিৎপুর রোডের একটি জুতোর দোকানে তিনি বসেছিলেন। সেখান থেকে লক্ষ্য করলেন এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা ক্লান্ত শরীরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। পরনে মলিন ছোট ধুতি আর ছেঁড়া জামা। ধূলি ধূসরিত পা দিয়ে রক্ত পড়ছে।”
“ব্যথায় মুচড়ে উঠলো তার মন, এবং বৃদ্ধের সেই করুণ মুখের ছবিটি চেক সাহেবের হৃদয়ে আঁকা হয়ে গেল চিরতরে। দ্রুত পকেট থেকে নোট বই বার করে তিনি কিছু লিখলেন। তার সেই নোট বইয়ের প্রথম পাতাটিতে লেখা ছিল একটি নাম- টমাস বাটা।”

তখন ভারতে জুতা আসত মূলত জাপান থেকে। তবে তার দাম বেশি ছিল বলে পরাধীন ভারতে কেনার সামর্থ্য বেশি মানুষের ছিল না। টমাস বাটা আসার আগেই ১৯২৮ সালে কলকাতার চৌরঙ্গি ও লিন্ডসে স্ট্রিটের কোণে ছোট্ট একটি বাটার দোকান খোলা হয়েছিল। তবে কোনো কারখানা ছিল না। আমদানি করলে জুতার দাম কমবে না বলে টমাস বাটা ভারতের প্রাণীর চামড়া ব্যবহার করে জুতা তৈরির কথা ভাবেন। সেই ভাবনা থেকেই কলকাতার উপকণ্ঠে হুগলি জেলার ছোট্ট
জনপদ কোন্নগরে সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি তেলকল ভাড়া নিয়ে বসান জুতার কারখানা। তাতে কাজ করতে আসে চেকস্লোভাকিয়া থেকে আসা একটি দল। সেখানে একটি বাংলো বাড়ি হয় তাদের আবাস।
এর মধ্যে কোন্নগড়ে ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে জুতা তৈরিতে চামড়ার ব্যবহার নিয়ে আপত্তি তুলল। আবার জুতার পসার বাড়ায় ওই কারখানায় স্থান সঙ্কুলানও হচ্ছিল না। তাই কলকাতা পোর্ট কমিশনের কাছ থেকে ১৯৩৪ সালে গঙ্গার অন্য দিকে ‘নুঙ্গী’ নামে বিশাল জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত প্রান্তর কিনে সেখানেই কারখানা নিয়ে যান বাটা। সেই কারখানা ঘিরেই গড়ে ওঠা নগরীর নামই হয়ে উঠল বাটানগর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি জুতা আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাটার ব্যবসায় তখন শনৈ শনৈ উন্নতি। তখন সাধারণ মানুষকে জুতা পায়ে দিতে উৎসাহিত করে বাটার বিজ্ঞাপন ছিল- “ধনুষ্টঙ্কার হইতে সাবধান, সামান্য ক্ষত হইতে মৃত্যু ঘটিতে পারে। জুতা পরুন।”
বাটার গল্পে ইসরায়েল কোথায়?
ছোট একটি জুতার কারখানা থেকে বহুজাতিক হয়ে ওঠা বাটার ইতিহাসের প্রায় পুরোটাই প্রকাশ্য। সেখানে ইসরায়েলের যোগসূত্রের কোনো খবর পাওয়া যায় না।
বাটা কোম্পানির জন্ম টমাস বাটার হাত ধরে ১৮৯৪ সালের ২৪ আগস্ট, মোরাভিয়া রাজ্যের জিলিন শহরে। একই স্থানটি পরে চেকস্লোভাকিয়া দেশ হয়, তারও নাম বদলে এখন চেক রিপাবলিক।
বাটার প্রতিষ্ঠাতা টমাস বাটা ১৯৩২ সালে মারা যাওয়ার পর কোম্পানির দায়িত্ব নেন তার সৎ ভাই আন্তোনিন বাটা। পরে অবশ্য টমাস বাটার ছেলে টমাস জন বাটা কোম্পানির হাল ধরেন। আর তার মাধ্যমেই বাটা বিশ্বজুড়ে জুতার জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে।

বাটার সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও চেকস্লোভাকিয়ায় অনেক ইহুদি বাটা কোম্পানিতে কাজ করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার চেকস্লোভাকিয়া দখলের পর যখন ইহুদি নিধন শুরু করেছিল, তখন টমাস বাটা জুনিয়র তার ইহুদি কর্মীদের প্রাণ বাঁচাতে ভিন্ন দেশে কাজ দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৩৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে জুনিয়র বাটা বলেছিলেন, “জার্মান সংবাদমাধ্যমের শত আক্রমণের পরও আমি ইহুদি বলতে লজ্জিত হতাম না; যদিও আমি ইহুদি নই। তবে আমি সব মানুষকে সমান মনে করি।”
যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসও জুনিয়র বাটার এই উক্তি ছেপেছিল। এই উক্তির খণ্ডিত অংশ ধরে কারও তাকে ইহুদি ভাবার সুযোগ হয়ত রয়েছে; যদিও মানবতাবোধ থেকে তিনি তখন ইহুদি না হয়েও তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
সোমবার বিভিন্ন বিক্রয় কেন্দ্রে হামলার পর বাটা বাংলাদেশের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা লক্ষ্য করছি বাটাকে ঘিরে বিভ্রান্ত তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি ইসরায়েলি মালিকানাধীন বা চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত।
“বাটা একটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক মালিকানাধীন চেক রিপাবলিকভিত্তিক কোম্পানি, ইসরায়েল বা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সঙ্গে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন চেকস্লোভাকিয়া কমিউনিস্ট দেশ হয়, তখন সব কারখানা জাতীয়করণ করে। মজার ব্যাপার হলো, তখন চেক সরকার বাটাকে ইহুদি-বিদ্বেষী নাজিদের দোসর হিসাবে চিহ্নিত করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাটা কর্পোরেশনের কার্যক্রম কানাডায় নিয়ে যান বাটা জুনিয়র। পরে সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এখন রয়েছে সুইজারল্যান্ডে।
বাটার কর্ণধারদের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা তাদের কর্মীদের কাছছাড়া করেন না। চেকস্লোভাকিয়া থেকে কানাডায় ব্যবস্থা স্থানান্তরের সময়ে বিশাল এক কর্মী বাহিনীকে নিয়ে গিয়েছিলেন বাটা।
শুধু তাই নয়, বাটার মালিকদের কারখানা ঘিরে নিজস্ব একটি শহর গড়ে তোলার প্রবণতাও রয়েছে। ফলে কলকাতাররর বাটানগরীর মতো কানাডায় রয়েছে বাটাওয়া, নেদারল্যান্ডসে রয়েছে বাটাডর্ফ, স্লোভাকিয়ায় রয়েছে বাটাভানি, চেক রিপাবলিকে রয়েছে বাটাভ, সুইজারল্যান্ডে রয়েছে বাটা পার্ক, ব্রাজিলে রয়েছে বাটাতুবা, পাকিস্তানে রয়েছে বাটাপুর ইত্যাদি।
টমাস বাটা জুনিয়রের স্ত্রী সঞ্জা বাটার উদ্যোগে ১৯৭৯ সালে কানাডার টরন্টোতে গড়ে তোলা হয় বাটা জুতা জাদুঘর।