হাদির গুলিবিদ্ধের ঘটনায় কার ফায়দা? বিএনপি-জামায়াত মুখোমুখি

ব্যাটারিচালিত রিকশায় বসা ওসমান হাদিকে গুলি করেন মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ব্যক্তি। দ্রুত ঘটনা ঘটিয়ে তারা ওই মোটরসাইকেলে সেখান থেকে চলে যানছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেওয়া
ব্যাটারিচালিত রিকশায় বসা ওসমান হাদিকে গুলি করেন মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ব্যক্তি। দ্রুত ঘটনা ঘটিয়ে তারা ওই মোটরসাইকেলে সেখান থেকে চলে যানছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেওয়া

ভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ইনকিলাব মঞ্চ নামে একটি সংগঠনের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদি, যিনি ঢাকার একটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে রাজনীতির ভাষায় অশ্রাব্য শব্দের ব্যবহারের জন্য যে কয়েকজনের নাম আসে হাদি তাদের একজন। মাদ্রাসা থেকে উঠে আসা এই সংগঠকের তীব্র ভাষার বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন সময় দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে প্রতিবাদ এসেছে।

তার উগ্র আচরণ এবং ভাষা ও পোশাকের কারণে তিনি শিবির বা হিজবুত তাহরীরের কর্মী বলে কেউ কেউ সন্দেহ করে থাকেন। যদিও তার সহকর্মীদের দাবি, জুলাই অভ্যুত্থানের আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না হাদি; তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করতেন।

শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় দুই যুবক চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে রিকশায় থাকা ওসমান হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলেও পরে বেসরকারি এভার কেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, “হাদির অবস্থা ক্রিটিক্যাল (আশঙ্কাজনক)। তাকে ‘লাইফ সাপোর্ট’ দেওয়া হয়েছে। বুলেটটি (গুলিটি) তার মাথার ভেতরে রয়েছে।”

এদিকে হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় বিএনপিকে দায় দিতে চাইছে একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির। অল্প সময়ের মধ্যে প্রথম পোস্ট দেন ছাত্রশিবির নেতা ও ডাকসু ভিপি আবু সাদিক কায়েম।

তিনি লেখেন: “ওসমান হাদীকে গুলি করা হল। চাঁদাবাজ ও গ্যাংস্টারদের কবল থেকে ঢাকা সিটিকে মুক্ত করতে অচিরেই আমাদের অভ্যুত্থান শুরু হবে। রাজধানীর ছাত্র-জনতাকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানাচ্ছি।”

বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা ৫৩ মিনিটে দেওয়া ওই পোস্টের পর শিবির ও জামায়াতের অনুসারীদের পোস্টে সোশাল মিডিয়া সয়লাব হয়ে যায়। সাদিকের পোস্টে পড়ে প্রায় ১৫ হাজার কমেন্ট।

তাদের বেশিরভাগের পোস্টের ভাষা অবিকল: ঘটনায় জড়িত বিএনপি; চাঁদাবাজদের হাত থেকে দেশকে রক্ষায় জামায়াতই বিকল্প। তবে এ নিয়ে বিএনপি সমর্থক ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ হাদির ঘটনায় জামায়াতের ‘গুপ্ত ভূমিকা’ থাকার সন্দেহ প্রকাশ করলে নড়ে চড়ে বসেন তারা।

নতুন করে পোস্ট দিয়ে এবার এ ঘটনায় ‘পতিত ফ্যাসিস্টদের’ প্রতি ইঙ্গিত করেন সাদিক।

৩টা ৪২ মিনিটে দেওয়া ওই পোস্টে এবার তিনি লেখেন: “জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই রাজধানীতে একজন প্রার্থীকে গুলি করা হল। খুবই অশনিসংকেত। পতিত ফ্যাসিস্টরা এই নির্বাচন প্রতিরোধে ইতোমধ্যে নানান কর্মসূচি ও হুমকি দিয়েছে। ফ্যাসিস্টদের দেশি-বিদেশী দোষররাও আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দিতে চায় না। এমতাবস্থায়, প্রার্থীর উপর হামলায় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া এবং প্রার্থীদের নিরাপত্তা প্রশ্নে আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে।

“অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি, অতিসত্ত্বর এই গুলিকারীকে চিহ্নিত করতে হবে এবং একই সাথে এই ঘটনার পেছনের রাজনৈতিক মোটিভ উদ্ঘাটন করে জাতিকে জানাতে হবে। একইসাথে আহ্বান জানাবো, দলমত নির্বিশেষে যেসব প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারের জন্য মাঠে থাকবেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।”

ঘটনার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওসমান হাদিকে দেখতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের ইঙ্গিতও ছিল বিএনপির দিকে।

সাংবাদিকদেরকে তিনি বলেন, “কেউ যদি আবার বাংলাদেশে নতুন করে ফ্যাসিজম বা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চান, তাহলে খুব দেরি হবে না যথাযথ জবাব পেয়ে যাবেন। জনগণ সব ষড়যন্ত্র রুখে দেবে।”

“কাউকে এ ধরনের নোংরামি করার সুযোগ দেওয়া হবে না। বাংলাদেশের মাটি কারও বাপ–দাদার জমিদারি নয়, এটা ১৮ কোটি মানুষের সম্পদ,” যোগ করেন তিনি।

জামায়াতের প্রতি সহমর্মী হিসেবে পরিচিত এবি পার্টিও স্বাধীনতাবিরোধী দলটির মতো একই আশঙ্কা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে, যাতে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে ইঙ্গিত করে দেওয়া বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন খোদ দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

হাদির ওপর গুলিবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে এ অবস্থায় “বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসীদের” ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, “দেশ এখন অত্যন্ত সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী প্রতিটি দল ও ব্যক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।”

তারেক রহমান কার্যত জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বলেন, “আমরা দেখেছি গত এক বছরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা হুমকি দিয়েছে প্রকাশ্যে যে প্রত্যাশিত নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে, সে নির্বাচনকে তারা হতে দেবে না, বাধাগ্রস্ত করবে।”

একটি দল, গোষ্ঠী বা কিছু ব্যক্তি এই দেশকে দেশের মানুষের শান্তি স্থিতিশীলতা বিনষ্টের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ওসমান হাদির ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালানোর ঘটনাকে সন্ত্রাসী অপতৎপরতার নগ্ন দৃষ্টান্ত আখ্যা দিয়ে কঠোর ভাষায় এর নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ জাসদ।

এক বিবৃতিতে দলটির সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, “নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর একজন প্রার্থীকে লক্ষ্য করে এমন সশস্ত্র হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্য পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত ষড়যন্ত্রের অংশ।”

“নির্বাচনকে আতঙ্কিত ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নেওয়ার জন্যই এই হামলা চালানো হয়েছে—এটি স্পষ্ট,” বলা হয় বিবৃতিতে, যা বিএনপির ইঙ্গিতকে সমর্থন করছে।

পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আর বিবৃতির মধ্যে সাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি সোশাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিংয়ে পরিণত হয়। অজস্র পোস্টে জামায়াতকে ইঙ্গিত করে এর পেছনে নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা দেখছেন অনেকেই। তবে হাদির ঘটনায় কে কাকে ঘায়েল করতে চাইছে, তার জবাব পেতে হয়তো আরও খানিকটা সময় লাগবে।

সরকারের তরফে বলা হয়েছে, ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; তারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

আরও পড়ুন