এ যেন রবিঠাকুরের মাস্টারবাবু ছড়া; সবারই এটি জানা- “আমি আজ কানাই মাস্টার/ পোড়ো মোর বেড়ালছানাটি/ আমি ওকে মারি নে মা, বেত/ মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি/ আমি বলি চ ছ জ ঝ ঞ/ ও কেবল বলে মিয়োঁ মিয়োঁ।”
পালাবদলের বাংলাদেশে এখন বিএনপি যতবারই ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা তুলছে; অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ততবারই বলছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে।
শুরুটচা আজ নয়, গত বছরের ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে। বিএনপি অতি শিগগির ভোট চাইলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কিছুটা মিইয়ে যায় খালেদা জিয়ার দল। তখন অভ্যুত্থানের তরুণ তুর্কিদের কথায় নেচে ইউনূসও বলতে থাকেন, আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন।
সেই তরুণরা যখন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে জুলাই সনদ, সংস্কার, সংবিধান সংশোধন, গণপরিষদ এসব আওয়াজ তোলার পর যখন বিএনপি দেখল, নির্বাচন দূরে সরে যাচ্ছে, তখন বিএনপি খানিকটা শক্ত হয়ে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি তোলে।
গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে সেই দাবি জানিয়ে হুমকিও দিয়ে বসে বিএনপি; সাফ জানিয়ে দেয়, ডিসেম্বরে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে আর সহযোগিতা নয়।
এরপরই এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বরাতে জানা যায় যে মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে চাইছেন। তারপর ইউনূসকে রাখার পক্ষে শুরু হয় অনলাইনে প্রচার, একজন সম্পাদক মিনতি জানান, ‘আপনি চলে যাবেন না’।
যদিও এর সবই নাটক বলে সন্দেহ বিএনপির নেতাদের মনে, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মতো কোনো কোনো নেতা তা প্রকাশ্যে বলেও ফেলেন।

এরপর ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে বৈঠকে ডাকেন। প্রথম দিন শনিবার বিএনপির পাশাপাশি ডাক পড়ে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির।
এনসিপি সংস্কারে জোর দেয়, জামায়াত থাকে মাঝামাঝি অবস্থানে, আর বিএনপি বরাবরের মতোই ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি জানায়। সেদিনও ইউনূস বলেন, নির্বাচন হবে ডিসেম্বর থেকে ্আগস্টের মধ্যে।
তাতে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হন বিএনপি নেতারা। বুধবার ঢাকায় তারুণ্যের সমাবেশ ডেকে সেই সভায় বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বেশ জোরের সঙ্গেই বলে, নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হতে হবে।
“আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে, ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে,” বলে দলীয় নেতা-কর্মীদের ভোটের প্রস্তুতি নিতে বলেন তিনি।
তারেক যখন একথা বললেন, তখন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস জাপান সফরে। সেখান থেকেই খবর এল, জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তারো আসোর সঙ্গে বৈঠকে ইউনূস বলেছেন আগের কথাই, অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “অধ্যাপক ইউনূস তারো আসোকে বলেছেন যে নির্বাচন (চলতি বছরের) ডিসেম্বর থেকে (আগামী বছরের) জুন- এই ছয় মাসের সময়সীমার মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।”
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে তারেক রহমানের বক্তব্যের খবর ইউনূসের অজানা থাকার কথা নয়। আর তারেক এই বক্তব্য দিয়েছেন লন্ডনে থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে। সুতরাং এই ধারণা করাই যায় যে তারেকের কথা শোনার পরই ইউনূসের কথা শুনিয়েছেন প্রেস সচিব শফিকুল।
প্রেস সচিব সেই সঙ্গে আরও যা জানালেন, তা ঢাকার সড়কের ‘গেইট লক’ বাস সার্ভিসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। গেইট লক বাস যখন স্টপেজে স্টপেজে যাত্রী তোলা শুরু করে, তখন তার ওপর যাত্রীদের আস্থা নষ্ট হয়ে পড়ে। তখন কন্ডাক্টরদের বলতে হয় ‘খোদার কসম গেইট লক’।
শফিকুল আলম এদিন আবার বললেন, “প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এই সময়সীমার (ডিসেম্বর থেকে জুন) পরে তিনি আর একদিনও ক্ষমতায় থাকবেন না।”
কিন্তু তাহলে নির্বাচনের দিনক্ষণ প্রকাশ করে রোডম্যাপ ঘোষণায় সরকারের দেরি কেন? সেই প্রশ্ন তুলছেন বিএনপি নেতারা। আবার জুন মাসে বর্ষার কারণে নির্বাচন উপযোগী পরিবেশ না থাকায় তা ভোট পেছানোর ছুতো হতে পারেও বলেও সন্দেহ দলটির নেতাদের।
বুধবারের সমাবেশে তারেক রহমান বলেন, “আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মনে হয় এরই ভেতরে টালবাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের অভিনব শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ।”

অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা্র জন্য তিন মাসই যথেষ্ট সময়।
“অতীতে বিভিন্ন সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন করেছে। প্রতিক্ষেত্রেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসে জাতীয় নির্বাচন সফল করেছে। বাংলাদেশেই রেকর্ড আছে নির্বাচন তিন মাসে সম্ভব। কিন্তু আজ দেখছি ১০ মাস হয়ে গেল, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করছে না।”
তারেক বলেন, “জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ও বাইরে কারও কারও মনে হয় ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।”
ভিন্ন উদ্দেশ্য কী হতে পারে? সেনিয়ে নানা কথা রয়েছে। তবে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে ইউনূস তার নিজের কথারই বরখেলাপ করছেন।
গত বছর জুলাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন বিদেশে থেকে বিবৃতি দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করছিলেন নোবেলজয়ী ইউনূস, আন্দোলনকারীদের রক্ষায় চাইছিলেন বিদেশি হস্তক্ষেপ। ২৬ জুলাই ভারতের সংবাদপত্র হিন্দুকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনার সরকারকে বিদায় নিতে হবে, নতুন নির্বাচন দিতে হবে দ্রুত।
তার সেই সাক্ষাৎকারের দিকে ইঙ্গিত করে এক সময়ের সাংবাদিক, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক সাইফুল আলম চৌধুরী বুধবার এক টিভি টক শোতে প্রশ্ন তুললেন, তখন কাজটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল ড. ইউনূসের কাছে, কয়েক দিনের মধ্যে তার গুরুত্ব তারই কাছে কীভাবে হারিয়ে গেল?