৭১কে পেছনে ফেলার চিন্তা কারও কারও আছে: সাক্ষাৎকারে ফখরুল

বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে জুলাই অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পরপরই কেউ কেউ একে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

তিন দিন পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে দেশে ফিরেই মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয়কে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলার পর সেই তুলনা হাওয়া পায়।

পরের মাসে নিউ ইয়র্কে গিয়ে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউনূস ‘রিসেট বাটন’ চেপে পুরনো সব কিছু মুছে দেওয়ার কথা বললে ওই তুলনা বড় ভিত্তি পায়।

যদিও পরে প্রধান উপদেষ্টা দপ্তর থেকে ব্যাখ্যা আসে যে ‘রিসেট বাটন’ টেপার মাধ্যমে একাত্তরের অর্জনকে মুছে ফেলার কথা বলেননি ইউনূস। তারপরও এই তুলনা থেমে নেই।

মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে আড়াল করতে এটা যে কেউ কেউ করে যাচ্ছে, সে বিষয়ে সচেতন থাকার কথা বললেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও।

তিনি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (বুধবার প্রকাশিত) বলেছেন, এই আন্দোলনের পর একটা পক্ষ ১৯৭১ কে পেছনে ফেলতে চায়।

“আমার কাছে কেন জানি মনে হয় যে, একটা পক্ষ একাত্তরকে একটু পেছনে রাখতে চায়”- তিনি একথা বলার পর সাক্ষাৎকার গ্রহীতা জানতে চেয়েছিলেন, কারা?

উত্তরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আছে কিছু হয়তো। তারা চেষ্টা করছেন। এটা আমার মনে হচ্ছে। আমি এক্সাক্টলি আপনাকে ঠিক বলব না, বলতে পারব না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, একাত্তরকে পেছনে ফেলার একটা চিন্তা-ভাবনা কারো কারো মধ্যে থাকতে পারে।”

একাত্তরকে পেছনে ফেলা হলে কার সুবিধা হয়- জানতে চাইলে তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, “যাদের সুবিধা হবে, সেটা আপনারা জানেন সবাই। আমি রিপিট করেতে চাই না।”

বিএনপি মহাসচিব না বললেও তার দলের বিভিন্ন নেতার কথায় জামায়াতে ইসলামীর দিকেই আঙুল ওঠে। এই দলটি এক সময় বিএনপির প্রধান রাজনৈতিক মিত্র হিসাবে থাকলেও এখন দুই দলের নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার খোরাক জোগাচ্ছে।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছিল।

১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থন নিয়েই বিএনপি সরকার গঠন করেছিল। এরপর তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলেও ১৯৯৮ সালে তারা চারদলীয় জোটে ঐক্যবদ্ধ হয়।

এরপর ২০০১ সালে জোট সরকারে খালেদা জিয়া মন্ত্রী করেছিলেন জামায়াতের তখনকার দুই শীর্ষনেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মো. মুজাহিদকে।

দুজনকেই পরে আওয়ামী লীগ আমলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়। গত বছরের জুলাইয়ে শেখ হাসিনার সরকার নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধও করে।

আমার কাছে কেন জানি মনে হয় যে, একটা পক্ষ একাত্তরকে একটু পেছনে রাখতে চায়। এটা আমার মনে হচ্ছে। আমি এক্সাক্টলি আপনাকে ঠিক বলব না, বলতে পারব না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, একাত্তরকে পেছনে ফেলার একটা চিন্তা-ভাবনা কারো কারো মধ্যে থাকতে পারে।

তবে তার পরের মাস অগাস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জামায়াতকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে স্থান পেতে দেখা যাচ্ছে। তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞাও তুলে দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়ার গড়া বিএনপিকে দলটির নেতারা ‘মুক্তিযোদ্ধাদের দল’ হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিতে চান বরাবরই। জামায়াতকে আগে সঙ্গে রাখলেও মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার ভূমিকাও বড় করে দেখাতে সব সময় আগ্রহী বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

জামায়াতের বাইরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রনেতাদের মধ্যেও কেউ কেউ জুলাই অভ্যুত্থানকে একাত্তরের চেয়ে সামনে রাখতে প্রয়াসী। তারা স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও ‘ফ্যাসিবাদী শাসক’ হিসাবে প্রত্যাখ্যান করতে চান।

অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরে যুক্ত থাকলেও পরিচয় লুকিয়ে যে আন্দোলন সংগঠনে ছিলেন, তা পরে প্রকাশ পায়।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরতে না দেওয়ার ঘোষণাও রয়েছে অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের।

চরম নাজুক অবস্থায় থাকা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরত আসা কিংবা ভোটে অংশ নেওয়া নিয়ে বিবিসি বাংলা প্রশ্ন করেছিল তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির মহাসচিব ফখরুলকে। জবাবে তিনি বলেন, তারা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নন।

ফখরুল বলেন, “আমি একটা পলিটিক্যাল পার্টি। আমরা নীতিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক দলকে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে রাজনীতি করে, তাদেরকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারটাতে আমরা কখনোই একমত হইনি। এটা আমরা বলেছি যে, জনগণ ডিসাইড করবে যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে, নাকি হবে না।”

জনগণ কীভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে-প্রশ্নে তিনি বলেন, “জনগণ যদি চায় যে, তারা কোনো দলকে নিষিদ্ধ করবে, তাহলে তারা করতেই পারে। সেটা কীভাবে হবে? সেটা পার্লামেন্টে হতে পারে বা অন্য কোনো মাধ্যমে হতে পারে। ভোটের মাধ্যমে সেটা জানা যাবে। ইলেকশনের মাধ্যমেই সেটা জানা যাবে।”

আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে চান কি না- সেই প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আওয়ামী লীগ আসতে পারলে আসবে, না আসতে পারলে আসবে না। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, কোন দল নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, সেটা তো দলগুলো নিজেরাই ঠিক করবে। আমরা মনে করি কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব আমাদের না। আমরা চাই যে, জনগণের মাধ্যমে সবকিছু নির্ধারিত হবে।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা আওয়ামী লীগকে হটানোর কৃতিত্ব দাবি করলেও বিএনপি নেতারা বলছেন, ৩৬ দিনের আন্দোলনে কোনো সরকারের পতন হয় না। বিএনপির ধারাবাহিক সংগ্রামও এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির এখন দূরত্ব তৈরি হয়েছে কি না- সেই প্রশ্নে ফখরুল বলেন, তিনি তা মনে করেন না।

আমরা তো চাই আর্লি ইলেকশন। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কার, যেটা ন্যূনতম সংস্কার, সেগুলো করে যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা। উনি (ইউনূস) যতগুলো সংস্কারের মধ্যে হাত দিয়েছেন, অতগুলো সংস্কার করতে গেলে ১০ বছরের মধ্যেও শেষ হবে না।

নির্বাচনের জন্য এই অভ্যুত্থান হয়নি- জুলাই আন্দোলনের নেতাদের এমন কথার জবাবে আবার তিনি বলেন, “আমরা আন্দোলন করেছি দেশে একটা ডেমোক্রেটিক সেটআপের জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠান জন্যে। আর গণতন্ত্রে ঢোকার প্রথম ধাপটিই হচ্ছে, নির্বাচন। সুতরাং নির্বাচন প্রধান নয়, একথা চিন্তা করাও তো ভুল।”

‘সংস্কার অ্যাপ্রুভ করবে কে?’

ইউনূস সরকার সংবিধানসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারকে অগ্রাধিতার দিলেও বিএনপি নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে।

সাক্ষাৎকারেও ফখরুল বলেন, “আমরা তো চাই আর্লি ইলেকশন। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কার, যেটা ন্যূনতম সংস্কার, সেগুলো করে যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা।”

সংস্কার নিয়ে তিনি বলেন, “উনি (ইউনূস) যতগুলো সংস্কারের মধ্যে হাত দিয়েছেন, অতগুলো সংস্কার করতে গেলে ১০ বছরের মধ্যেও শেষ হবে না।”

অনির্বাচিত এই সরকার যেটুকু সংস্কার করবে, সেটুকু কার্যকরের জন্যও নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে ফখরুল বলেন, “আপনি সংস্কার দিলেন, কিন্তু সেটাকে অ্যাপ্রুভ করবে কে? আইনগত যাদের অধিকার আছে, তারাই করতে পারবে। দ্যাট ইজ পার্লামেন্ট। পার্লামেন্ট ছাড়া কিন্তু সাংবিধানিক সংস্কার কঠিন হবে। এমনকি অন্যান্য বিষয় কতগুলা আছে, যেগুলা আপনার সংবিধানে কিছু কিছু পরিবর্তন আনার দরকার আছে। কিন্তু সেগুলা পার্লামেন্ট ছাড়া সম্ভব না।”

বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, সংস্কারের যেসব সুপারিশ আসছে, তার অনেকগুলোই তাদের প্রস্তাবেই রয়েছে।

নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে হলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ থাকার ওপরও জোর দেন বিএনপি মহাসচিব। নইলে ভোটের সময় সরকার পরিবর্তনের আওয়াজ তোলেন তিনি।

ফখরুল বলেন, “যদি সরকার পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা নির্বাচন কনডাক্ট করা পর্যন্ত থাকবেন। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।”

কেন নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “এখানে আমরা জিনিসটা লক্ষ্য করছি যে, ছাত্ররা একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করার কথা চিন্তা করছেন। সেখানে যদি ছাত্রদের প্রতিনিধি এই সরকারে থাকে, তাহলে তো নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। ওইটা হচ্ছে, সম্ভাব্য কথা।

“কিন্তু যদি তারা মনে করে যে, (সরকারে) থেকেই তারা নির্বাচন করবেন, তাহলে তো রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না।”

তবে এখন পর্যন্ত এই সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপির কোনো প্রশ্ন নেই বলে জানান ফখরুল এবং সরকারকে সহযোগিতা করে যাওয়ার কথাই বলেন তিনি।

আরও পড়ুন