গণভোট নিয়ে বিএনপি এখন শাঁখের করাতে

জুলাই সনদে সই করার দিনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পাশে ছাতা হাতে বিএনপির নেতারা। ফাইল ছবি
জুলাই সনদে সই করার দিনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পাশে ছাতা হাতে বিএনপির নেতারা। ফাইল ছবি

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর একটি গণভোট হয়েছিল বাংলাদেশে। সেই ভোটটি ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যেতে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এই ভোটে রাজি ছিলেন না। কিন্তু চাপে পড়ে নিমরাজি হন। সেই ভোটে ‘হ্যাঁ’ জিতেছিল।

তিন যুগ পর আবার একটি গণভোটের সামনে বাংলাদেশ। এবারও বিএনপি আছে দোটানায়। যে প্রশ্নে মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গণভোট আয়োজন করতে যাচ্ছে, সেখানে ‘হ্যাঁ’ ভোট দেওয়া বিএনপির জন্য কঠিন, তেমনি ‘না’ ভোট দেওয়াও কঠিন। বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে বিএনপি পড়েছে শাঁখের করাতে।

জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানসহ রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তনের মতো বিতর্কিত কাজে হাত দিয়েছে। অনেকে বলছেন, একে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা।

আট মাসের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্রদের বাদে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে  বৈঠক করে জুলাই সনদ তৈরি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত ১৮ অক্টোবর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ দল তাতে সই করে। কমিউনিস্ট পার্টিসহ চারটি দল এতে সই করেনি। তাদের ভাষ্য, এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে কাজ হচ্ছে। আবার অভ্যুত্থানকারী তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সই করেনি সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা না পেয়ে।

সনদ সইয়ের পর গোল বাধে এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে। গণভোট প্রশ্নে বিপরীত অবস্থান নেয় বিএনপি ও জামায়াত। এক সময়ের মিত্র দল দুটির মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা এখন ক্রমেই বাড়ছে।

দলগুলো একমত না হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার পর জুলাই সনদ বাস্তবায়নে অধ্যাদেশ জারি হয়। তাতে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।

গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে জুলাই সনদে সই করে রাজনৈতিক দলগুলো।

ঘোষণা অনুযায়ী, গণভোটে প্রশ্ন থাকবে একটি। ভোটাররা সম্মত হলে ‘হ্যাঁ’ এবং অসম্মত হলে ‘না’ ভোট দেবেন। ‘হ্যাঁ’ ভোট দেওয়ার অর্থ চারটি প্রস্তাব মেনে নেওয়া।

তার প্রথমটি হচ্ছে- নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে- আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।

তৃতীয়টি হচ্ছে- সংসদে নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।

চতুর্থটি হচ্ছে- জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।

গণভোট আগে চেয়েছিল জামায়াত, সেই দাবিতে ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে তারা আন্দোলনেও নেমেছে। বিএনপি চেয়েছিল সংসদ নির্বাচনের দিন। এক্ষেত্রে তাদের দাবি পূরণ হয়েছে।

কিন্তু যে প্রশ্নে গণভোট হচ্ছে, তার বেশ কয়েকটি বিষয়ে আপত্তি তুলেছিল বিএনপি। তারা তো জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারিরই বিপক্ষে ছিল। কিন্তু সেটাই হয়েছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতি নিয়ে বিএনপির আপত্তি ছিল। বিএনপির চাওয়া ছিল, উচ্চকক্ষে ১০০ আসন বণ্টন হোক নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে। কিন্তু গণভোটের প্রশ্ন হবে, দলগুলোর ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হবে। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের মতামত নেয়ারও বিরোধী ছিল বিএনপি।

তাহলে যদি বিএনপিকে এখন হ্যাঁ ভোট দিতে হয়, তাহলে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে যেতে হবে। যেহেতু হ্যাঁ ভোট দিতে হলে সব প্রস্তাব মিলিয়েই দিতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের প্রতিক্রিয়া নেতিবাচকই ছিল। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় তিনিই দলের প্রতিনিধিত্ব করতেন।

তিনি বলেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস ভাষণের মধ্য দিয়ে নিজের সই করা জুলাই জাতীয় সনদই লঙ্ঘন করেছেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আগে থেকে বলে আসছিলেন, তাদের ওপর জুলাই সনদ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এক অর্থে সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে তা চাপিয়ে দিয়েছে বলাই যায়। কিন্তু দুপুরে সালাহউদ্দিন চড়া সুরে প্রতিক্রিয়া জানালেও রাতে বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় দেখা গেল নরম সুর।

সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানায় বিএনপি। তাতে বোঝা গেল বিএনপি চাপিয়ে দেয়া বোঝা বহনই করবে বলে মনস্থির করেছে।

বিএনপি নেতা জয়নুল আবদিন ফারুক। ছবি: বাসস

কিন্তু আসলে কি করবে? বিএনপি নেতাদের কথায় তা বোঝা যাচ্ছে না। দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক শুক্রবার নোয়াখালীতে তার নির্বাচনী এলাকায় এক সমাবেশে গণভোটে ‘না’ ভোট দিতে দলীয় নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, “এবার ভোটারদের হাতে দুইটা ব্যালট থাকবে। একটি হবে ধানের শীষ, দাঁড়িপাল্লাসহ বিভিন্ন প্রতীকে। আরেকটি হবে গণভোটের, হ্যাঁ বা না। আমাদের নেতারা আপনাদের বুঝিয়ে দেবেন। সে ক্ষেত্রে ‘না’ হবে।”

তার মানে কী দাঁড়াল? বিএনপি কি ‘না’ ভোট দেবে? সম্প্রতি ফেইসবুকে বিএনপির সমর্থকরা ‘না’ ভোটের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছিল, তাতে সামনের দিনগুলোতে বিএনপির অবস্থান আসলে কী হয়, তা এখন দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন