ইসলামী আন্দোলনকে কাছে টেনে কী পেতে চায় বিএনপি

ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বৈঠক।
ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বৈঠক।

বাংলাদেশে ইসলামি দল আছে অনেক; তবে ভোটের হিসাব করলে সামনে থাকে দুটি দল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত ৩৩ লাখ ভোট (৪.৭%) পেয়ে আসন জিতেছিল দুটি। সেই নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন পেয়েছিল সাড়ে ৬ লাখ (প্রায় ১ শতাংশ) ভোট। দুই প্রধান জোটের বাইরে তারা একক দল হিসাবে সবচেয়ে বেশি ভোট পেলেও আসন জেতেনি একটিও।

এর কারণ হতে পারে কোনো জোটে তাদের না থাকা। জামায়াত বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে জোটে আছে ১৯৯৯ সাল থেকে। এই জোটে যাওয়া নিয়ে তখন জামায়াতের বিষোদগার করেছিলেন ইসলামী আন্দোলনের তখনকার আমির, চরমোনাই পীর সৈয়দ ফজলুল করিম।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধভাবেই নির্বাচন করেছিল। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন (তখন নাম ছিল ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন) এইচ এম এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে ইসলামী ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ভোটে নেমেছিল।

বিএনপির জোটে বিভিন্ন সময় অনেকগুলো ইসলামী দল থাকলেও চরমোনাই পীরের দলটিকে তারা কখনও জোটে পায়নি। ফজলুল করিম মারা যাওয়ার পর তার ছেলে সৈয়দ রেজাউল করীম নেতৃত্বে আসার পরও নয়।

তবে গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে চিত্র গেছে অনেক পাল্টে। দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের কাছ থেকে বিএনপি এখন দূরে। দুই দলের নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রাজনীতির আঙিনায় এখন আলোচনার বড় খোরাক জোগাচ্ছে।

এর মধ্যেই গত ২১ জানুয়ারি হঠাৎ করেই বরিশালে চরমোনাই পীরের দরবারে গিয়ে হাজির হন জামায়াত আমির শফিকুর রহমান। তিনি ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ রেজাউল করীমের সঙ্গে বৈঠক করেন। দুজনে একসঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজও সারেন।

জামায়াত ও চরমোনাই পীরের আদর্শগত অনেক ফারাক থাকায় তাদের এই মিলন রাজনীতিতে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি করে। বিএনপিকে ছেড়ে জামায়াত এখন ইসলামি অন্য দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আনতে চাইছে, এমন কথাও ছড়ায়।

তখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, যিনি জোট রাজনীতির লিয়াজোঁর দায়িত্বে ছিলেন এক সময়, নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় বলেছিলেন, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের বৈঠক নিয়ে তাদের দুচিন্তার কোনো কারণ নেই।

তবে দুশ্চিন্তা যে ভেতরে ভেতরে হচ্ছিল, তা বোঝা গেল ছয় দিন পর সোমবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ঢাকায় ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে ছুটে যাওয়ায়।

সাধারণত বিএনপির কার্যালয়েই যান তাদের জোটসঙ্গী দলগুলোর নেতারা। কিন্তু পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে বিএনপির মহাসচিব ফখরুলই গেলেন, ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলুকে সঙ্গে নিয়ে। তারা বৈঠক করলেন ইসলামী আন্দোলনের চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউল করীমের সঙ্গে। মধ্যাহ্ন ভোজও সারলেন একসঙ্গে।

কী হলো বৈঠকে

ইসলামী আন্দোলনের আমির ও বিএনপির মহাসচিব বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানান, তাদের আলোচনায় ১০টি বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। মির্জা ফখরুলই যৌথ সিদ্ধান্তগুলো সাংবাদিকদের পড়ে শোনান।

বিষয় ১০টি হলো-

১. আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম টেকসই রাষ্ট্র গঠনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা

২. দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি ও টাকা পাচারকারীদের দ্রুত বিচার

৩. ভোটাধিকারসহ সব ধরনের মানবাধিকার রক্ষায় জাতীয় ঐকমত্য গড়া

৪. ন্যূনতম সংস্কার শেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ

৫. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে ও সব অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং আইনশৃঙ্খলার স্বাভাবিক করা

৬. আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা

৭. ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে আঘাত করে কথা না বলা

৮. আগামীতে আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী শক্তি যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে, সেই বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকা

৯. ইসলামি শরিয়াহবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া এবং ইসলামবিরোধী কোনো কথা কেউ না বলা

১০. প্রশাসনে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদের দোসরদের দ্রুত অপসারণ করা

রেজাউল করীম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আলোচনান্তে এ বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছেছি এবং আমরা আপনাদের সহযোগিতা কামনা করছি।”

মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে তার এই সভাটি ছিল ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’।

বিএনপি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাইছে, সেই বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের চাওয়া নিয়ে চরমোনাই পীর রেজাউল করীম বলেন, “আমরা ‘দ্রুত সময়’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। এবং বেশি সময়টা না নিয়ে যৌক্তিক— সেই যৌক্তিক সময়টা আমরা বলেছি এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে।”

জামায়াত ইসলামী দলগুলোকে কাছে টানতে চাওয়ার পথ ধরার পর বিএনপি মহাসচিব ফখরুল এর আগে গত ২২ জানুয়ারি খেলাফত মজলিসের আমিরের সঙ্গেও বৈঠক করেন।

খেলাফত মজলিস এক সময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে ছিল। ২০২১ সালের অক্টোবরে তারা জোট ছেড়ে যায়। প্রায় তিন বছর পর তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বিএনপি।

সেই বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী’ সব রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে তারা।

এর মধ্যে জামায়াত আমিরের সঙ্গে বৈঠকের পর গত ২৪ জানুয়ারি চরমোনাই পীর ঢাকায় দলের এক কর্মসূচিতে বলেছিলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ‘ইসলামের পক্ষে’ একক প্রার্থী দেওয়ার একটি চেষ্টা চলছে।

তার তিন দিন পরই তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে গেল বিএনপি। তবে নির্বাচনী জোট নিয়ে তারা কোনো কথা বলেনি।

তবে চরমোনাই পীর বলেছেন, “আমাদের দুই দলের মধ্যে আলোচনা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে।”

বিএনপি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, আগামী নির্বাচনে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতলেও জাতীয় সরকার গঠন করবে।

সেই প্রতিশ্রুতি ধরে দৃশ্যত এখন সব রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ইসলামি দলগুলোকে কাছছাড়া করতে চাইছে না তারা।

ইসলামী আন্দোলনের বাঁক বদল

ইসলামি অন্য আরও দলের মতো ইসলামী আন্দোলন এর আগে কখনও বিএনপির এত কাছাকাছি আসেনি। বরং বিএনপি যখন নির্বাচন বর্জন করছিল, তখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটে অংশ নিয়ে যাচ্ছিল তারা। সেই কারণে দলটিকে আওয়ামী লীগের কাছের বলেই মনে করত বিএনপি সমর্থকরা।

হাফেজ্জী হুজুরের শিষ্য চরমোনাই পীর সৈয়দ ফজলুল করীমসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ১৯৮৭ সালে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন নামে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে একে রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করেন চরমোনাই পীর, ১৯৯০ সালের পরে। ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়ার জন্য নাম বদলে এটি হয় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, তাদের প্রতীক হয় হাতপাখা।

এই দলের আদর্শ তুলে ধরতে গিয়ে ফজলুল করিম বলেছিলেন, ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ার লক্ষ্যে যৌথ নেতৃত্বভিত্তিক ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন গঠন করা হয়েছে। ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি বিজয়ী আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

শুরুতে ভারতবিরোধী নানা কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকত দলটি। তসলিমা নাসরিনকে দেশছাড়া করার দাবি তুলে, সালমান রুশদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে আলোচনায় আসে দলটি।

১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটি আরও ৭টি দলের সমন্বয়ে ইসলামী ঐক্যজোট নামে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। পরে আবার একলা হয়ে যায়। ২০০১ সালের ভোটের আগে জাতীয় পার্টির সঙ্গে মিলে দলটি গঠন করে ইসলামী ঐক্যফ্রন্ট। তবে সেই জোটে ভিড়েও সংসদে কোনো আসন পায়নি দলটি।

তার আগে ১৯৯৯ সালে শায়খুল হাদিস আজিজুল হক বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যোগ দেওয়ায় একাধিক সভা-সমাবেশে তাকে বিষোদগার করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ফজলুল করীম। তখন থেকেই কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি আমলে যখন স্থানীয় নির্বাচন বয়কট করছিল আওয়ামী লীগ, তখন ইসলামী আন্দোলন নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়েছিল।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর একই ধারায় চলে ইসলামী আন্দোলন। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচন তারা অন্য সব দলের মতো বয়কট করলেও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়ে যাচ্ছিল।

২০১৫ সালে ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটের হিসাবে তারা তৃতীয় অবস্থানে ছিল। ২০১৬ সালের নারায়ণগঞ্জ ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও তারা তৃতীয় অবস্থানে ছিল। ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তৃতীয় এবং রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তারা চতুর্থ হয়।

২০১৮ সালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কোনো জোটে না গিয়ে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয় দলটি। অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করলেও ১.৫ শতাংশ ভোট পায় তারা।

অন্য দলগুলোর বর্জনের মধ্যেও ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে যাচ্ছিল ইসলামী আন্দোলন। কিন্তু তাতে ছন্দপতন ঘটে ওই বছরের জুনে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়।

ওই নির্বাচনে হাত পাখার মেয়র প্রার্থী ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের আমিরের ভাই ফয়জুল করীম। কিন্তু ১৬ জুন ভোটের দিন তার ওপর হামলা হলে দলটি বরিশাল তো বটেই, অন্য সিটি করপোরেশনগুলো থেকেও প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয়।

সেই থেকে আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে বিএনপির কাছাকাছি যেতে থাকে ইসলামী আন্দোলন। বিএনপি তখন সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে ছিল।

২০২৩ সালের নভেম্বরে ইসলামী আন্দোলন ঢাকায় এক সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছাড়ার জন্য সময় বেঁধে দেয়। সেই সঙ্গে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিতেও সমর্থনের ঘোষণা দেয়।

সেই সমাবেশে রেজাউল করীম বলেন, “সরকার দাবি না মানলে আন্দোলনরত বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন মানুষ হতে দেবে না।”

এরপর বিএনপিকে অনুসরণ করে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনও বর্জন করে ইসলামী আন্দোলন। আওয়ামী লীগের পতনের পর এখন বিএনপির আরও কাছাকাছি যাচ্ছে দলটি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads