রাখঢাক ছেড়ে বিএনপি-এনসিপি এখন মুখোমুখি

গ্রাফিক্সে বিএনপি ও এনসিপির বর্তমান অবস্থা।
গ্রাফিক্সে বিএনপি ও এনসিপির বর্তমান অবস্থা।

এতদিন চলছিল আকারে-ইঙ্গিতে; এখন খোলাখুলিভাবেই চলছে বাক আক্রমণ। অভ্যুত্থানের বছর গড়ানোর আগেই বিএনপি আর জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পাল্টাপাল্টি হুঁশিয়ারি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

সোমবার এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সরাসরি বিএনপিকে ‘চাঁদাবাজদের দল’ আখ্যায়িত করেন। তাদের মিছিলে স্লোগান উঠছে- ‘চাঁদা তোলে পল্টনে- ভাগ যায় লন্ডনে’।

পাল্টায় বিএনপির সমাবেশ থেকেও স্লোগান উঠছে- ‘এক বোতল, দুই ছিপি-জামাত আর এনসিপি’। এনসিপি নেতাদের কথায় ‘ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’ পাওয়ার কথাও বলেছেন বিএনপির নেতারা।

গত বছরের আগস্টে যে অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, তার নেতৃত্বে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই প্ল্যাটফর্মের নেতারাই গত ফেব্রুয়ারিতে এনসিপি গড়ে রাজনীতির মাঠে নামেন।

অভ্যুত্থানের পর বিএনপির সঙ্গে এনসিপির সুসসম্পর্ক দেখা গেলেও ক্রমে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে বিএনপির এক সময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সখ্য দেখা যাচ্ছে এনসিপির। তাতে বিএনপি ও জামায়াতও এখন দুই মেরুতে সরে গেছে।

সম্প্রতি পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে ভাঙারি দোকানি লালচাঁদ সোহাগকে পিটিয়ে হত্যার পর লাশের পাথর ছুড়ে উল্লাসে বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলোর স্থানীয় নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগ এলে তা নিয়ে সরব হয় এনসিপির নেতা-কর্মী-সমর্থকরা।

এক পর্যায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে অশালীন স্লোগান দেওয়া হলে তা তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে দলটির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে।

তারেক নিজেই লন্ডন থেকে শনিবার দলের এক সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, “আমি আজ থেকে ৮-৯ মাস আগে বলেছিলাম, অদৃশ্য শত্রু আছে। সেই অদৃশ্য শত্রু ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে।”

নয়া পল্টনে সমাবেশে বিএনপি নেতারা।

জুলাই অভ্যুত্থানের বার্ষিকী উপলক্ষে দেশজুড়ে পদযাত্রায় থাকা এনসিপির নেতারাও কথা বলতে থাকেন। দুদিন আগেই এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরউদ্দীন পাটওয়ারী এক সমাবেশে বলেন, “ব্যবসায়ীরা আগে শেখ হাসিনার সিরিয়াল ধরত, এখন ধরে লন্ডনের সিরিয়াল।”

কয়েকদিন ধরে সমাবেশে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ বিএনপিকে ইঙ্গিত করে কথা বললেও সোমবার পটুয়াখালীর সমাবেশে একেবারে নাম ধরেই ‘চাঁদাবাজদের দল’ বলেন।

তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেন, “চাঁদাবাজ ও মুজিববাদের নতুন পাহারাদার এসেছে। সেই পাহারাদারকেও আপনাদের প্রতিহত করতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা বলেছিলাম, বাংলাদেশে মুজিববাদ বিভাজন তৈরি করেছে, মুজিববাদী সংবিধান বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এগোতে দেয়নি। কিন্তু সেই মুজিববাদী সংবিধানকে টিকিয়ে রাখতে চাইছে এখন বিএনপি। বিএনপি এখন চাঁদাবাজদের দল তৈরি হয়েছে, মুজিববাদের নতুন পাহারাদার হিসাবে আবির্ভুত হয়েছে।”

বিএনপিকে ইঙ্গিত করে এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, “আমরা অনৈক্য চাই না, বিভাজন চাই না। তবে কেউ যদি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিপক্ষে দাঁড়ায়, তাদের সঙ্গে আমাদের ঐক্য সম্ভব নয়।”

এদিন এরপর বরগুনায় পথসভায় নাহিদ বিএনপিকে ইঙ্গিত করে আবার বলেন, “আমরা বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি করি। ভারত কিংবা পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির আর কোনো জায়গা বাংলাদেশে হবে না। একটি রাজনৈতিক দল একসময় পাকিস্তানপন্থীদের পুনর্বাসন করেছিল, এখন আবার মুজিববাদীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে। মুজিববাদের পাহারায় রয়েছে চাঁদাবাজ ও দখলদার চক্র।”

সোমবার নাহিদের এই বক্তব্য আসার আগে সকালেই ঢাকায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির নেতারা।

সেখানে তারেক রহমানকে জড়িয়ে অশালীনে স্লোগানদাতাদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়। ফখরুল এনসিপির নাম না নিয়ে বলেন, “সরকার পরিচালনার দায়িত্বে না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল ও তার প্রধান নেতৃত্বকে দায়ী করে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন এবং অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আবারও সেই ফ্যাসিবাদের যুগে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।”

লালচাঁদ হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন পেছানোর দুরভিসন্ধি চলছে বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।

এরপর বিকালে নয়া পল্টনে ঢাকা মহানগর বিএনপির সমাবেশে ফখরুল বলেন, “আমি ধিক্কার জানাতে চাই সেই সমস্ত তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের, যারা তারেক রহমানকে নিয়ে অশ্লীল ভাষায় কথা বলছেন। আমরা তাদের বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষায় কথা বলব না। এটা মাথায় রাখতে হবে, আমাদের নেতাকে অশ্লীল কথা বললে তার মান ছোট হয় না। ছোট হয় তারা যারা অশ্লীল ভাষায় কথা বলে।”

নড়াইলে সমাবেশে এনসিপি নেতারা।

লালচাঁদ হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার মাহিনের সঙ্গে এনসিপি নেতাদের ছবি রয়েছে দাবি করে  নিয়ে তিনি বলেন, “আমি দেখাতে পারি, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি এই ছেলের সঙ্গে ওদের (এনসিপি) ছবি রয়েছে। কিন্তু বিএনপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

ফখরুল নাম না ধরলেও একই সমাবেশে এনসিপির নাম ধরে হুঁশিয়ার করে দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।

তিনি আরও বলেন, “একটি দল স্লোগান দিচ্ছে- আওয়ামী লীগ গেছে যেই পথে, বিএনপি যাবে সেই পথে। অত সহজ নয়। আমাদের কোথাও যাওয়ার রাস্তা নাই। এই বাংলাদেশ আমাদের স্থায়ী ঠিকানা।

“তারেক রহমান সম্পর্কে যদি কেউ অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেন, আমরাও তাকে ছাড়ব না।”

নিজেদের এক সময়ের জোটসঙ্গী দল জামায়াতের সমালোচনা করে মির্জা আব্বাস বলেন, “আরেকটি দল যারা লম্বা লম্বা কথা বলা ছাড়া আর সুকৌশলে হাদিয়া নেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নাই। টাকা নিয়েছেন বসুন্ধরা ও সিটি গ্রুপের কাছ থেকে। সমস্ত কিছুর হিসাব হবে।

“নিজের পায়ে জোর নেই। এরশাদের সময় এরশাদের কাঁধে ভর করেন, আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করেন। আর এখন লম্বা লম্বা কথা বলেন। এখন বিএনপি ওনাদের একমাত্র মাথাব্যথা। বিএনপিকে যদি শেষ করে দেওয়া যায়, তাহলে ওনারা একক রাজত্ব করতে পারবেন।”

এই সমাবেশে বিএনপি যেমন তাদের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচারকারীদের’ রুখবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তেমনি আবার এনসিপি নেতারাও ‘চাঁদাবাজ ও ফ্যাসিবাদের পাহারাদারদের’ প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগবিহীন রাজনীতির মাঠে এখন তাই ছড়াচ্ছে উত্তাপ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads