জনপ্রশাসনে ক্যাডারে-ক্যাডারে দ্বন্দ্ব চরমে

২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ শুক্রবার সভা করে।
২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ শুক্রবার সভা করে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংঘটিত অভ্যুত্থানের ফসল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। তার একটি হচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সেই কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর এক প্রস্তাব জনপ্রশাসনে তৈরি করেছে অস্থিরতা।

জনপ্রশাসনে প্রশাসন ক্যাডার সব সময়ই কর্তৃত্ব করছিল। সংখ্যায় ও ক্ষমতায় তারাই ভারী। মুয়ীদ চৌধুরী পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডারের কোটা সমান করার কথা বলেছিলেন। তাতে ক্ষুব্ধ প্রশাসন ক্যাডার। বিপরীতে অন্য কাডারের কর্মকর্তারাও সরব হয়ে উঠেছেন।

কী বলেছিলেন মুয়ীদ চৌধুরী

মুয়ীদ চৌধুরীকে সভাপতি করে গত ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। তার দেড় মাস পর গত ১৭ ডিসেম্বর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে কমিশন।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর তথ্য অনুসারে ওই সভায় মুয়ীদ চৌধুরী বলেছিলেন, জনপ্রশাসনে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশের কোটা সুপারিশ করা হবে।

বর্তমানে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ নেওয়া হয়।

তার বক্তব্যের পরপরই প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরব হন। দুই পক্ষের কেউই সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব মানতে রাজি নন।

সরকারের হুমকি উপেক্ষা করে ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তারাই সভা, কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।

কমিশন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে না রেখে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো আলাদা করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে। তা নিয়েও আপত্তি ওই দুটি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের।

বৈষম্য নিরসনের দাবি ২৫ ক্যাডারের

২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ গঠন করে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরছে। শুক্রবার তারা ঢাকার ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে সভা করে।

ওই সভায় বলা হয়, সিভিল সার্ভিস শাসন করছে প্রশাসন ক্যাডার। প্রশাসন ক্যাডারের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা আন্তঃক্যাডার বৈষম্য বাড়িয়েছে। অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছে।

‘জনবান্ধব সিভিল সার্ভিস বিনির্মাণে করণীয়: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই আলোচনা সভায় বিভিন্ন ক্যাডারের ৮ হাজারের মতো কর্মকর্তা যোগ দেন। ১৫টির বেশি ক্যাডারের ১৯ জন কর্মকর্তা সভায় বক্তব্য দেন।

তারা দাবি তোলেন, ‘ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’ হতে হবে, উপসচিব পদে কোটাপদ্ধতি বাতিল করতে হবে এবং সব ক্যাডারের সমতা নিশ্চিত করতে হবে।

বক্তারা উপসচিব পদে কোটাপদ্ধতি বাতিল করে সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবি করেন। প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রাখা এবং বাকি ২৫টি ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ রাখার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তারা।

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন পরিষদের সমন্বয়ক কৃষিবিদ মো. আরিফ হোসেন। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ থাকায় এই মুহূর্তে বৃহৎ কর্মসূচি থেকে তারা বিরত থাকবেন। তবে আগামী এক মাস ছাত্র-জনতার সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।

২৫টি ক্যাডার বৈষম্যের শিকার বলে উল্লেখ করেন বিসিএস সমবায় অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ২৭ বছরের চাকরিজীবনে তিনি বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ একটিও পাননি। সব প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে নিচ্ছে।

“আমার ট্রেনিংগুলো মন্ত্রণালয়ের অফিসার নিয়ে যায়। সে ট্রেনিংয়ের পরে আবার চলে যায় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যে ট্রেনিং প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার জন্য এসেছিল, সেটা গ্রহণ করে সে চলে যায় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে।”

বিসিএস পরিবার পরিকল্পনা অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল কাশেম বলেন, সিভিল সার্ভিসের মধ্যে একটি ক্যাডার শাসকের ভূমিকায় রয়েছে। সমতায়, মর্যাদায়, সম্মানে—সব জায়গায় তারা ২৫ ক্যাডারকে বঞ্চিত করেছে। সেই ক্যাডার গত ১৭ বছরে বৈষম্য তৈরি করেছে।

“বিপ্লবের পর সেই একটি ক্যাডারের লোকদের প্রশাসক হিসেবে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব বসানো হয়েছে। বিপ্লবের পর সংস্কারের দায়িত্বও সেই একটি ক্যাডারকে দেওয়া হয়েছে। যারা বৈষম্য তৈরি করল, তাদের দিয়েই বৈষম্য নিরসনের দায়িত্ব দেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়?”

শিক্ষা ক্যাডার সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার বলে অভিযোগ করেন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক মো. সিরাজুল ইসলাম।

ক্যাডার সার্ভিস থেকে স্বাস্থ্য খাতকে বের করে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয় বলে হুঁশিয়ার করেন বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ নেয়ামত হোসেন।

তিনি বলেন, “ক্যাডার সার্ভিস থাকার ফলে (চিকিৎসকদের) মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার যে সুযোগ ছিল, সেই রাস্তা বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। আগামী এক দশক স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের ভার স্বাস্থ্য ক্যাডারের হাতে তুলে দেওয়া হলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভালো করবে।”

সরকারকে হুঁশিয়ারি প্রশাসন ক্যাডারের

কোনও সুপারিশ জমা দেওয়ার আগে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর প্রস্তাব উত্থাপন নিয়ে প্রবল আপত্তি উঠেছে প্রশাসন ক্যাডার থেকে। গত ২৫ ডিসেম্বর প্রশাসন ক্যাডারের এক সভা থেকে মুয়ীদ চৌধুরীর পদত্যাগও দাবি করা হয়।

অ্যাডমিন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা গত ২৫ ডিসেম্বর সভা করে।

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এবং বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড আয়োজিত ওই সভায় প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা যোগ দেন।

ঢাকার বিয়াম মিলনাতনের ওই সভায় কনিষ্ঠ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা উপস্থিতি ছিলেন। সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৯৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তা পর্যন্ত অংশ নেন। ঢাকার বাইরের জেলা প্রশাসকেরা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছিলেন এই সভায়।

পদোন্নতি নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে ওই সভায় বক্তারা বলেন, মীমাংসিত বিষয়ে এ ধরনের প্রস্তাব সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত।

উপসচিব পদে পদোন্নতির বিষয়ে কোটা নিয়ে উচ্চ আদালতের একটি রায়ও আছে। উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ ও অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ নেওয়া হয়। বর্তমানে কর্মরত উপসচিবের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৬০০।

সভায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি এ বি এম আব্দুস সাত্তার কমিশন থেকে মুয়ীদ চৌধুরীকে অপসারণের দাবি জানিয়ে সহকারী কমিশনার থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত পদগুলোর সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানান।

বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সোহেল রানা সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন ইতিহাস ও নানা তথ্য তুলে ধরে বলেন, উপসচিবের পদটি শুধু প্রশাসন ক্যাডারের জন্য রাখা উচিৎ। উপসচিব পদ নিয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ‘বৈষম্যমূলক, অযৌক্তিক ও ষড়যন্ত্রমূলক’।

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ কঠোর কর্মসূচির হুমকি ও নিজেদের ছয় দফা ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, “প্রথমত, আমরা এক আছি, এক থাকব। দ্বিতীয়ত, আমরা প্রশাসন ক্যাডারের ওপর কোনো রকমের সার্জারি বা কোটা আরোপ করতে দেব না। তৃতীয়ত, কমিশন কোনো অযাচিত সুপারিশ করলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। চতুর্থত, প্রশাসনে কোনো পর্যায়ে অন্ধভাবে বহিরাগত কাউকে বসানোর চেষ্টা করা হলে তা কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। পঞ্চমত, পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বঞ্চিত কর্মকর্তাসহ সব ধরনের কর্মকর্তাকে সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ষষ্ঠত, দেশকে কোনোভাবে অস্থিতিশীল করার জন্য যেকোনো ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার জন্য প্রশাসন সারাদেশে সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করবে।”

আরও পড়ুন