শাহরিয়ার কবিরকে মুক্তি দিতে বলল জাতিসংঘ

ইউএনএইচআরসি।
ইউএনএইচআরসি।

লেখক, গবেষক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শাহরিয়ার কবিরকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ‘আইনি মানদণ্ড ভঙ্গ’ হওয়ার কথা বলেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল (ইউএনএইচআরসি)।

কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপের এক প্রতিবেদনে তাকে মুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়েছে।

গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার বনানী এলাকা থেকে আটক করা হয় শাহরিয়ার কবিরকে। পরে জুলাই আন্দোলনের সময়কার একাধিক মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার দেখায়।

সেই থেকে এই মানবাধিকার কর্মী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা কারাগারে রয়েছেন, যিনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

এরই মধ্যে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দায়ের হওয়া সব মামলায় একাধিকবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাকে।

শাহরিয়ার কবিরের জামিন চেয়ে তার আইনজীবীরা আবেদন জানালেও তা নাকচ করা হয়।

গেল মাসে কারাবন্দী সাংবাদিক ও লেখক শাহরিয়ার কবিরের মুক্তি এবং তার নিরাপত্তা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পাঁচটি সংগঠন। যেগুলোর মধ্যে ছিল, সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরাম, ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম, ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ ইন জার্মানি, আর্থ সিভিলাইজেশন নেটওয়ার্ক (গ্লোবাল নেটওয়ার্ক), ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস অ্যালায়েন্স (গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম)।

গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করার পর একাধিকবার রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে লেখক ও গবেষক শাহরিয়ার কবিরকে। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে মামলা চলার মধ্যে চলতি বছরের শুরুর দিকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা গবেষক শাহরিয়ার কবিরের পক্ষে ইউএনএইচআরসির কাছে একটা অভিযোগ দায়ের করা হয়, যেখানে আইনি প্রক্রিয়া লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ ছিল।

অভিযোগের বিষয়ে সম্প্রতি ‘নির্বিচারে গ্রেপ্তার’ শিরোনামে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে ইউএনএইচআরসির ওয়ার্কিং গ্রুপ।

১১ পৃষ্ঠার সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহরিয়ার কবিরের বিষয়ে জানতে তারা চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে বার্তা পাঠিয়েছিল, যার জবাব দেওয়ার সময়সীমা ছিল ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত।

ইউএনএইচআরসি বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে জবাব আসে ১৩ মে। নির্ধারিত সময়ে জবাব না আসায় তা আমলে না নিয়ে অন্যান্য প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে ওয়ার্কিং গ্রুপ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শাহরিয়ার কবির এক বছরের বেশি সময় ধরে আটক আছেন, কিন্তু এখনো তার বিচারকাজ শুরু হয়নি।

নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি–ইসিসিপিআরের উদ্ধৃতি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন আটক ব্যক্তির অর্থবহ ও নিয়মিত বিচারিক পর্যালোচনার অধিকার থাকতে হবে।

টক শোতে কথা বলার ‘ভিত্তিহীন’ অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তুলে ধরে ইউএনএইচআরসি বলেছে, টক শোতে বক্তব্য দেওয়া আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) অধীনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে, যতক্ষণ না তা ‘অনুমোদিত’ সীমা লঙ্ঘন না করে।

লেখক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক শাহরিয়ার কবির।

অন্তর্বর্তী সরকার সেই সীমা লঙ্ঘন হওয়ার মতো কোনো প্রমাণ তুলে ধরেনি বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।

ইউএনএইচআরসি মনে করে, শাহরিয়ার কবিরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো কীভাবে হত্যা বা হত্যাচেষ্টায় উসকানি হিসেবে কাজ করেছে, সরকার সে প্রমাণও হাজির করতে পারেনি।

ইউএনএইচআরসি ওয়ার্কিং গ্রুপের পর্যবেক্ষণ বলছে, শাহরিয়ার কবির ‘চরমপন্থি মতাদর্শের’ বিরুদ্ধে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন, যার মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক বিষয়ক একটি তথ্যচিত্রও রয়েছে।

পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার বিচার দাবি করে আসছিলেন এবং এসব অবস্থান তার জন্য ‘শক্তিশালী রাজনৈতিক শত্রু‘ সৃষ্টি করে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া শাহরিয়ার কবির একজন শিশুসাহিত্যিকও। তিনি দীর্ঘদিন থেকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যক্রম নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন।

এ কমিটি গঠনে শাহরিয়ার কবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৪ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর তিনি কমিটির সভাপতি হন। ২০২৪ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাকে উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি করা হয়।

ছাত্রজীবন শেষে শাহরিয়ার কবির ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে জুলাই আন্দোলনের একাধিক মামলায় কারাবন্দি আছেন তিনি।

আরও পড়ুন