ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে একটি পরিকল্পনা তুলে ধরেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই পরিকল্পনাটি পুরোপুরি অনুসরণ করছেন।
নতুনভাবে গঠিত ‘ইহুদিবিরোধিতার বিরুদ্ধে ফেডারেল টাস্কফোর্স’-এর প্রধান লিও টেরেল ফক্স নিউজকে বলেন, “আমরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে দেউলিয়া করে দেব। আমরা তাদের সব ফেডারেল তহবিল বন্ধ করে দেব।”
তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, যদি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের নিয়ম না মানলে তাদের আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে। কারণ সরকার তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এলিট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঘিরে যা হাচ্ছে, তা কোনো বাড়িয়ে বলার কথা নয়। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তা দেশটির উচ্চশিক্ষা খাতে সরকারের ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে।
ট্রাম্প গত সপ্তাহে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কর-ছাড় সুবিধা বাতিলের উদ্যোগ নিয়ে এই অভিযানের সর্বশেষ ধাপ শুরু করেছেন। গত বুধবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক সংবাদমাধ্যম জানায়, ট্রাম্প আয়কর বিভাগকে হার্ভার্ডের কর সুবিধা বাতিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে সাংবাদিকদের আয়কর বিভাগের কাছে যেতে বলে। তবে তারা সঙ্গে সঙ্গে কোনো মন্তব্য দেয়নি।

ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, হার্ভার্ডসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর গাজা নিয়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভে ইহুদি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ট্রাম্প এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ফেডারেল তহবিল বন্ধ করার হুমকি দিয়েছেন। এই তহবিল বন্ধ করার মাধ্যমে তিনি শুধু ইহুদিবিরোধিতা দমন নীতিমালা কঠোর করতে বাধ্য করতে চান না। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগ ও ভর্তি নীতিতেও পরিবর্তন আনতে চান। তিনি “মতামতের বৈচিত্র্য” নিশ্চিত করার কথাও বলেন—যা অনেকের মতে, ডানপন্থি মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার একটি রূপান্তরিত শব্দ।
টেক্সাসের অস্টিনে অবস্থিত শিক্ষাবিষয়ক আইনজীবী স্কট শ্নাইডার বলেন, “গত কয়েক সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপ আগে কখনো দেখা যায়নি। ৬০-৭০ বছরের ইতিহাসে ফেডারেল সরকার কখনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল এমনভাবে বন্ধ করেনি।” তিনি এটিকে অত্যন্ত জোরপূর্বক ও নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেন।
ট্রাম্প নিজেও পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ছাত্র। তাই এই অভিযান তার রাজনৈতিক পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি যুক্তরাষ্ট্রের লিবারেল প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে তার সাংস্কৃতিক যুদ্ধের একটি দিক।
এই কঠোর অবস্থানের পেছনে আছেন ট্রাম্পের নীতিনির্ধারণী দলের উপপ্রধান স্টিফেন মিলার। তিনিই মূলত অভ্যন্তরীণ নীতির বড় অংশ চালাচ্ছেন।
একজন রিপাবলিকান কৌশলবিদ বলেন, “এটি রক্ষণশীলদের জন্য একটি মৌলিক বিষয়। বহু বছর ধরে রক্ষণশীলরা ও মিলার এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে বামপন্থি আদর্শের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বলে সমালোচনা করে আসছেন। এবার তারা সে বিষয়ে বাস্তব কিছু করতে পারছে।”
স্টিফেন মিলার অনেক আগে থেকেই ‘ওক’ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আসছেন। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেও তিনি তার সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ডিউকে ডেমোক্র্যাট শিক্ষকের সংখ্যা রিপাবলিকানদের তুলনায় ছয় গুণেরও বেশি।
২০০৫ সালে এক কলেজ পত্রিকায় লেখা একটি নিবন্ধে এক ছাত্র লিখেছিলেন, “সংরক্ষণশীল ছাত্রদের প্রায়ই কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়—তাদের বিশ্বাস প্রকাশ করবে, নাকি ভালো গ্রেড পাওয়ার সুযোগ হারাবে।”
এই ছাত্রই পরে ২০২১ সালে “আমেরিকা ফার্স্ট লিগ্যাল” নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, যাদের ‘ওক’ বা প্রগতিশীল নীতিগুলোকে তারা পক্ষপাতদুষ্ট বলে দাবি করে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি ট্রাম্প প্রশাসনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সের মধ্যেও দেখা যায়। তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটির একজন সাবেক ছাত্র। তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমাজে “নিত্য নতুন উদ্ভট মতবাদ”, যেমন ‘ক্রিটিকাল রেইস থিওরি’, ছড়িয়ে দিচ্ছে।
একটি বক্তৃতায় ভান্স বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর জ্ঞান ও সত্যের অনুসন্ধান করে না। তারা এখন মিথ্যা ও প্রতারণা ছড়ায়। এখন সময় এসেছে এই বাস্তবতা স্বীকার করার।”
এই দৃষ্টিভঙ্গি এখন রিপাবলিকান দলে বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে চলমান বিরোধে এটিই একটি যুক্তির ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। এমনকি হার্ভার্ডের সাবেক ছাত্রী ও নিউইয়র্কের রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য এলিস স্টেফানিকও এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন।

তিনি বলেন, “হার্ভার্ড তার প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতি ‘ভেরিটাস’ অর্থাৎ ‘সত্য’ অনুসরণে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এখন সময় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের করের টাকায় চলা সব অর্থ বন্ধ করার। হার্ভার্ডকে অর্থ দেওয়া বন্ধ করতে হবে।”
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম টার্গেট ছিল নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন হোয়াইট হাউসের চাপের মুখে শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে রাজি হয়। এর আগে তাদের ৪০০ মিলিয়ন ডলার ফেডারেল তহবিল স্থগিত করা হয়।
ওই অর্থ আর ফেরত দেওয়া হয়নি। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি প্রফেসরসের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইকেল থাডিয়াস বলেন, “একজন দমনকারীকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে লাভ নেই। সে আরও দাবি করবে। এটি কোনো আইনগত পদক্ষেপ নয়, এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা।”
সরকার তখন কলাম্বিয়ার ওপর আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ দাবি করে। পরে হার্ভার্ডকেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়। টেরেলের নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স দাবি করে, হার্ভার্ডকে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নিয়োগ দিতে হবে। মতাদর্শগত বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে একটি বাইরের সংস্থাকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে।
হার্ভার্ড সোমবার সরকারের এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করে জানায়, তারা তাদের স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকার ছাড়বে না। এর জবাবে হোয়াইট হাউস বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ফেডারেল তহবিল স্থগিত করে এবং কর-ছাড় সুবিধা বাতিলের হুমকি দেয়।
গত বুধবার সংবাদমাধ্যম জানায়, আয়কর বিভাগ ট্রাম্পের হুমকি কার্যকর করতে উদ্যোগ নিয়েছে। পরে হার্ভার্ড জানায়, এই পদক্ষেপ অবৈধ। তারা বলে, এই সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষামূলক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করবে, শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা কমাবে, গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা গবেষণা বন্ধ করবে। আর এতে নতুন উদ্ভাবনের সুযোগ নষ্ট করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলেন, হোয়াইট হাউসের এমন দাবির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া হার্ভার্ড প্রশাসনের কোনো উপায় ছিল না।
হার্ভার্ডের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক রায়ান এনোস বলেন, “এই দাবিগুলো ছিল চরম রকমের একনায়কতান্ত্রিক। এটি আমেরিকান ঐতিহ্যের সঙ্গে এতটাই সাংঘর্ষিক ছিল যে, নেতৃত্বের এর বিরোধিতা করাই স্বাভাবিক।”
অন্যদিকে অনেকের মতে ট্রাম্প প্রশাসন ইহুদিবিরোধিতার অভিযোগকে ব্যবহার করছে ইহুদি ভোটারদের রিপাবলিকান দলে টানতে।
হার্ভার্ডের সাবেক ছাত্র ও লেখক মাইকেল হির্শর্ন বলেন, “আমি নিজে ইহুদি এবং কখনোই মনে করিনি যে, ক্যাম্পাস বিক্ষোভগুলো কোনো আলাদা ধরনের হুমকি ছিল। কিন্তু এই ঘটনাগুলো ম্যাগা (মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন) আন্দোলনের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ইহুদি ভোটারদের স্থায়ীভাবে নিজেদের দিকে টানার। তারা ৭ অক্টোবরের ঘটনার ক্ষতিকে খুবই স্বার্থপরভাবে কাজে লাগাচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিরোধ আদালতে গড়ালে হার্ভার্ডের পক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে। এমনকি কিছু সংরক্ষণশীল মতাবলম্বীরাও মনে করেন, ‘দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র্য’ নিশ্চিত করার যে দাবি তোলা হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর অধীনে থাকা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে।

রাইটউইং হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম কিসেল বলেন, “শ্রেণিকক্ষে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, সেখানে হস্তক্ষেপ করা সরকারের পক্ষে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। কোনো ব্যক্তিগত মত বা বক্তব্যের ওপর ব্যবস্থা নিতে গেলে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী লঙ্ঘনের ঝুঁকি তৈরি হয়।”
তবে অনেকেই মনে করেন, হোয়াইট হাউস আদালতে হারলেও তারা তাদের মূল উদ্দেশ্যে অনেকটা সফল হবে। এই উদ্দেশ্য হলো—আমেরিকার আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রভাব ও প্রাধান্যকে দুর্বল করা এবং দেশের মানুষের কল্পনায় তাদের যে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, তা খর্ব করা।
আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা বেথ একারস বলেন, “আমি মনে করি, এখানে একটি মৌন উদ্দেশ্য কাজ করছে। সেটা হলো, সমাজের মনে উচ্চশিক্ষার এলিট প্রতিষ্ঠানগুলোর যে বিশেষ মর্যাদা তৈরি হয়েছে, সেটিকে দুর্বল করা।”
তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি জনসাধারণের আস্থা ধীরে ধীরে কমছে। “তাই এখনই এমন একটি রাজনৈতিক সময়, যখন জনমতকে নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে নেওয়া সম্ভব।”
তথ্যসূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস ও এফটি।