হোয়াইট হাউস গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ভুয়া ম্যাগাজিন কভার প্রকাশ করে, যেখানে তাকে মুকুট পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। কভারের পটভূমিতে ছিল নিউইয়র্ক শহরের দৃশ্য, আর শিরোনাম ছিল ‘লং লিভ দ্য কিং’। সময় নির্বাচনও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ—ঠিক তখনই ট্রাম্প প্রশাসন যানজট নিরসনের জন্য পরিকল্পিত মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা বাতিল করে।
কাকতালীয়ভাবে, পরদিন ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের ডিজিটাল সংস্করণও অনুরূপ প্রচ্ছদ প্রকাশ করে। সেখানে ট্রাম্পকে মুকুট পরিহিত দেখানো হয়, শিরোনাম দেওয়া হয় ‘দ্য উড বি কিং’। এটি নিছক রসিকতা নয়, বরং একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা।
সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ট্রাম্প
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের মধ্যে সবসময় আমেরিকার ‘রাজা’ হওয়ার বাসনা ছিল। প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি আন্তর্জাতিক নীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছেন— রাশিয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব, ইউক্রেনকে দূরে ঠেলে দেওয়া এবং ইউরোপীয় মিত্রদের উপেক্ষা করা। একই সঙ্গে ফেডারেল প্রশাসনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, কংগ্রেসের অর্থনৈতিক ক্ষমতা উপেক্ষা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংকুচিত করার পদক্ষেপ নিয়েছেন।
আমেরিকান গণমাধ্যমগুলোর দাবি, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর ব্যাপারে তথ্য বিকৃত করেছেন ট্রাম্প। তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে যুদ্ধের জন্য দায়ী করেছেন, যদিও বাস্তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনই প্রথম ইউক্রেনে ট্যাঙ্ক পাঠিয়ে সংঘাতের সূচনা করেন।
নতুন সাম্রাজ্যবাদ না কি রাজনৈতিক কৌশল
ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড, গাজা, পানামা খাল এবং কানাডার মতো বিদেশি ভূখণ্ডের মালিকানা দাবি করেছেন, যা সমালোচকদের মতে ২১শ শতকের আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের নতুন রূপ।
তিনি নির্বাহী আদেশের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। এত বেশি আদেশ এসেছে যে সব মনে রাখাই কঠিন। সরকারি কর্মকর্তারা এসব পদক্ষেপকে প্রশাসনিক সংস্কার হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও, বিশ্লেষকদের মতে এটি ক্ষমতার একচেটিয়া প্রয়োগ।
ট্রাম্প সবসময় শীর্ষস্থানে থাকতে চান— রিয়েলিটি টেলিভিশনে, রাজনীতিতে, এমনকি গল্ফ চ্যাম্পিয়নশিপেও। তার গতি ও কৌশল অনেককে চমকে দিচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, আগামী চার বছরে আরও বিস্ময়ের অপেক্ষা রয়েছে।
নজরদারিতে স্বাধীন সংস্থাগুলো
ট্রাম্প নির্বাহী শাখার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ চান। তিনি ডিসট্রিক্ট অব কলম্বিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ডাক পরিষেবা সরাসরি পরিচালনার পরিকল্পনা করছেন। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প যা কিছু দেখেন, সেটিকে নিজের কর্তৃত্বের আওতায় আনতে চান।
তবে তার শাসনশৈলী নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ মনে করেন, এই কঠোর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজনীয়, আবার অনেকে বলছেন, এটি নজিরবিহীন কর্তৃত্ববাদী মনোভাব।

ইউক্রেন যুদ্ধ: ট্রাম্পের অবস্থান বিতর্কিত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা ট্রাম্পের অন্যতম অগ্রাধিকার হলেও, তিনি ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ উল্টে দিয়েছেন। তিনি রাশিয়াকে ‘অবহেলিত’ হিসেবে দেখিয়েছেন, আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করেছেন। মস্কো তার অবস্থানকে স্বাগত জানালেও, জেলেনস্কি ট্রাম্পকে ‘ভ্রান্ত তথ্যের জগতে বসবাসকারী’ বলে অভিহিত করেছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে কী শর্ত মেনে নেওয়া হবে, সে বিষয়ে বিভ্রান্তিকর বার্তা দিচ্ছেন। তিনি জেলেনস্কিকে ‘নির্বাচনহীন স্বৈরাচার’ বলেছেন, অথচ তার বিশেষ দূত কিথ কেলগ কিয়েভে গিয়ে জেলেনস্কিকে ‘সাহসী নেতা’ বলে প্রশংসা করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই বৈপরীত্য ইউক্রেন সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের নীরব বিরোধীরা
ট্রাম্পের মন্তব্যের বিরোধিতা করতে কেউই প্রকাশ্যে সাহস দেখাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসের ব্রিফিংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওল্টজকে ট্রাম্পের ইউক্রেন সম্পর্কিত মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান। অথচ, কংগ্রেস সদস্য থাকাকালীন তিনি পুতিনকে দায়ী করতেন।
এদিকে, ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভান্স জার্মানির মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিলেও, রাশিয়ার হুমকি নিয়ে আলোচনা না করে ইউরোপীয় অভ্যন্তরীণ সমস্যার ওপর গুরুত্ব দেন।
ইউরোপীয় নেতাদের শঙ্কা
ইউরোপীয় মিত্ররা ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীলতা নিয়ে ক্রমশ সন্দিহান হয়ে উঠছেন। ২০২০ সালে ট্রাম্পের পরাজয়ের পর, তারা আশাবাদী ছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব আরও স্থিতিশীল হবে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেই আশা ভঙ্গ হয়েছে।
আগামী সপ্তাহে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প তাদের আশ্বস্ত করবেন যে, পুতিনের প্রতি তার ‘উষ্ণতা’ ও জেলেনস্কির প্রতি ‘কঠোর মনোভাব’ শুধু আলোচনার কৌশল।

সরকারি কাঠামোতে ইলন মাস্কের প্রভাব
ট্রাম্প প্রশাসনের সরকারি কার্যক্রম পর্যালোচনার দায়িত্ব পেয়েছেন ইলন মাস্ক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিওজিই’ (ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি) সার্ভিসের অধীনে কাজ করছেন।
ইতোমধ্যে মাস্ক ও তার দল সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রম বাতিল, চুক্তি স্থগিত এবং কিছু সংস্থা—যেমন ইউএসএআইডি—বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা সরকারি কর্মীদের বরখাস্ত করাসহ প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনছেন।
সরকারে অপচয় যে রয়েছে, তা কেউ অস্বীকার করেন না। প্রশাসনিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাও অনেকেই স্বীকার করেন। তবে সরকার কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। এটি অনেক এমন কাজ করে, যা শুধুমাত্র মুনাফার ভিত্তিতে পরিচালিত খাতের লোকজন সহজে বুঝতে পারেন না।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ইলন মাস্ক সরকারি সংস্থাগুলোর গুরুত্ব পুরোপুরি বোঝেননি। তিনি অনেক প্রোগ্রামকে প্রতারণামূলক মনে করে বন্ধ করে দিতে চান।
বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্পের নতুন কৌশল
বিচার বিভাগে ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন আইনজীবী পদত্যাগ করেছেন। প্রেসিডেন্ট ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস (ডিওজে) পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছেন।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত কাশ প্যাটেলকে এফবিআইয়ের পরিচালক বানিয়ে তিনি এমন একটি দল গঠন করেছেন, যা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারে।

আইনি লড়াই কি থামাতে পারবে ট্রাম্পকে
এখন পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে কেউ কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। তবে আদালত একমাত্র ব্যতিক্রম।
আইনি লড়াই এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও, ট্রাম্প অনেক মামলায় পরাজিত হতে পারেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীল সুপ্রিম কোর্টের রায় তার ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, আগামী বছরগুলোতে ট্রাম্পের ক্ষমতার পরিধি আরও বিস্তৃত হতে পারে। ওয়াশিংটন পোস্ট-ইপসোসের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ নিবন্ধিত ভোটার মনে করেন, ট্রাম্প তার প্রথম মাসেই ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে গেছেন।
তার কিছু নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত জনগণের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, এবং বেশিরভাগ আমেরিকান এগুলোর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন। তবে এই পরিসংখ্যান দলীয় বিভক্তিকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করতে পারে না।
এখনই বলা যাচ্ছে না যে, এমন জরিপ ফলাফল ট্রাম্প বা রিপাবলিকানদের ভবিষ্যতে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করবে কি না। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত— ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর ফলে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে।
ট্রাম্প প্রশাসনের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপগুলো নজরদারির দাবি রাখে, বিশেষ করে তার ক্ষমতা ব্যবহারের পন্থা ও কৌশলগুলো কীভাবে দেশের গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক নীতিতে প্রভাব ফেলে, তা আগামী দিনগুলোতে স্পষ্ট হবে। সুতরাং, ট্রাম্পের রাজনৈতিক অবস্থান ও তার প্রশাসনের সিদ্ধান্তগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ
ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা এবং তার কার্যকলাপ নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাত, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতা, এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বিভাজন—এগুলোই তার শাসনের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্যই, আগামী সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও প্রশাসনের এই গতিশীল পরিবর্তনগুলোর ওপর নজর রাখবেন বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা। কারণ এগুলো বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে।
সমালোচকরা যেমন সাবধান করছেন, তেমনই সমর্থকরা ট্রাম্পের দৃঢ় পদক্ষেপগুলোকে একটি নতুন দিগন্ত হিসেবে দেখছেন। এর ফলে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক উত্তেজনা ও বিতর্ক শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
ট্রাম্পের শাসনকাল শুধু একটি প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের সূচনা। তিনি যে ধরনের কৌশল অবলম্বন করছেন, তা দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিতরকার সাংবিধানিক কাঠামোর জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
এখনকার জন্য, বিশ্ব কৌতূহলের সঙ্গে অপেক্ষা করছে—ট্রাম্পের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কী হবে এবং সেগুলো কিভাবে আমেরিকার রাজনৈতিক ভূবিস্তারকে প্রভাবিত করবে।
তথ্যসূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, রয়টার্স।