এক দিনের ব্যবধানে দুটি বিয়ে; দুটিই হয়ে উঠল সংবাদের শিরোনাম। একটি সারজিস আলমের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা তিনি, যাদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে পতন ঘটেছিল শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনের।
শুক্রবার বিয়ে করেন সারজিস। শেরওয়ানি ও পাগড়ি পরে তার ছবি ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ছবিতে তার পাশে দেখা যায় মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে।
জুলাইয়ের আন্দোলনের নেতৃত্বে একসঙ্গে ছিলেন তারা। এখন মাহফুজ, নাহিদ, আসিফ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হয়েছেন হাসনাত। সারজিস নিয়েছেন নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠকের দায়িত্ব।
সারজিসের বিয়ের পরদিন চট্টগ্রামে নেভি কনভেনশনে সেন্টারে এক বিয়ে হয়ে ওঠে সোশাল মিডিয়ায় আলোচিত বিষয়। তবে প্রেক্ষাপট পুরোই ভিন্ন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক পরিচয়ে একদল ছাত্র গিয়েছিলেন সেই বিয়ে ভণ্ডুল করতে।
সেখানে নারী অতিথিদের হেনস্তার অভিযোগ ওঠার পর বাধে মারামারি। এরপর বরের বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে আসে। তার নাম ফখরুল আনোয়ার। তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক। তার আরেক পরিচয় তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির সাবেক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের (প্রয়াত) ভাই। সাবেক আরেক সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনির চাচাও তিনি।
গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার রোষানলে পড়ে এই দলের নেতারা। গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে নেওয়ার সময়ও তাদের ওপর হামলা হচ্ছিল। ‘মব’ গত আগস্ট=-সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে ছিল আলোচিত ঘটনা।
এক পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়। বলা হয়, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই পদক্ষেপ নেবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ কারও নেই।
বর্তমানে উপদেষ্টা (তখন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী) মাহফুজ আলম তখন বলেছিলেন, “সরকার এ ব্যাপারে (মব ঠেকাতে) যথেষ্ট কঠোর। ইতোমধ্যে অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কিন্তু তার হুঁশিয়ারিতেও মাজারে হামলা যেমন থামেনি, তেমনি এবার সব কিছু ছাপিয়ে বিয়ের আসরেও চলল মবের তাণ্ডব।
কার ছিল বিয়ে
সংবাদমাধ্যমে আসা তথ্যে জানা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম নগরীর টাইগারপাসে নেভি কনভেনশন সেন্টারে শনিবার রাতে ফখরুল আনোয়ার চৌধুরীর ছেলে সৈয়দ মিনহাজুল আনোয়ার এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমের নাতনি সৈয়দা মাহবুবা হোসনে আরা মনজুরের বিবাহোত্তর সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল।
মনজুর আলমের বড় ছেলে নিজামুল আলমের মেয়ে মাহবুবা। মনজুর আলম এক সময় আওয়ামী লীগ করতেন। পরে বিএনপিতে যোগ দিয়ে মেয়র হন। তার ভাতিজা দিদারুল আলম আবার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা, চট্টগ্রামের মেয়র শাহাদত হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আমন্ত্রিত ছিলেন।
কী ঘটেছিল সেখানে
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, রাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিলেন ফখরুল আনোয়ার। সে সময় হঠাৎ করে কনভেনশন সেন্টারের ভেতরে হৈ চৈ শুরু হয় এবং বাইরে থেকে একদল ব্যক্তি অনুষ্ঠানস্থল ঘিরে ফেলে।
বিবিসি বাংলার এই সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিয়েতে ফটিকছড়ির সাবেক এমপি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী ও খাদিজাতুল আনোয়ার সনি উপস্থিত আছেন-এমন শোরগোল তুলে রাত ১১টার দিকে হামলা শুরু হয়। তার আগে একদল ব্যক্তি কনভেনশন সেন্টারটির সামনে জমায়েত হয়ে শ্লোগান দিতে শুরু করে- ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার শুরু রাত সাড়ে ১০টায়। আওয়ামী লীগ আমলের দুই সংসদ সদস্যের উপস্থিতির খবর শুনে কনভেনশন সেন্টারে জড়ো হতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কর্মীরা। রাত পৌনে ১১টায় তারা ঘেরাও করেন কনভেনশন সেন্টার।
উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বর-কনে গাড়ি করে কনভেনশন সেন্টার ছেড়ে যায়। আমিন্ত্রত অতিথরাও যান চলে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা ভোররাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। তারা মাইজভান্ডারী ও খাদিজাতুল আনোয়ারকে গ্রেপ্তারের দাবি জানাতে থাকেন।
এরপর সেন্টারটির ভেতরে হামলা শুরু হয়। হামলাকারীরা ফখরুল আনোয়ারকে মারধর করেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। হামলার খবর পেয়ে পুলিশ ও নৌ-বাহিনীর সদস্যরা সেখানে ছুটে আসেন। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা লোকজন ও নৌবাহিনী সদস্যদের হাতে হামলাকারীদের কয়েকজন লাঠিপেটারও শিকার হন।
ওই সময়কার বেশি কয়েকটি ভিডিও আসে ফেইসবুকে। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য কনভেনশন সেন্টারের ভেতরে থাকা তিন থেকে চার তরুণকে লাঠিপেটা করছে। এতে এক তরুণের পরনের পোশাক ছিঁড়ে যায়। তাদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
মারধরের শিকার ব্যক্তিরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী বলে প্রথম আলোকে জানান কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, কনভেনশন সেন্টার এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা জড়ো হয়ে ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’ স্লোগান দিচ্ছেন। এই ভিডিওতে দেখা গেছে, জড়ো হওয়া তরুণরা কয়েকজনকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া করছেন। বয়স্ক একজন মেঝেতে বসেও পড়েন।
অনুষ্ঠানে ছিলেন এমন একজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলেন, হামলাকারীরা অতিথিদের অনেককে অপদস্থ করেছেন এবং কয়েকজন নারী অতিথিকে তারা হেনস্থাও করেন।
হামলাকারীদের কী বক্তব্য
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ওই বিয়েতে আওয়ামী লীগের দুই সাবেক সংসদ সদস্য মাইজভান্ডারী ও খাদিজাতুল আনোয়ার উপস্থিত ছিলেন বলে খবর পেয়ে তারা সেখানে গিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে পুলিশকেও জানিয়েছিলেন তারা।
সেখানে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের নেতারা দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন। জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত।
“এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতারা স্বাধীনভাবে সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন, চলাফেরা করবেন, ছাত্র-জনতা তা মেনে নেবেন না।”
ঘেরাও করে ফখরুল আনোয়ারকে আটকাতে পারলেও মাইজভান্ডারী ও খাদিজাতুল আনোয়ার পালিয়ে যান বলে তার দাবি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তুলে রাসেল বলেন, এতে তাদের সাত থেকে আটজন আহত হয়েছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
হামলার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার ও দুই সাবেক সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান তিনি।
ওই দুজন ছিলেন না, দাবি মনজুরের
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বিয়েতে দুই সাবেক সংসদ সদস্য থাকার কথা বললেও তা অস্বীকার করেছেন কনের দাদা, সাবেক মেয়র মনজুর আলম।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, “ছেলেরা এসে খাদিজাতুল ও নজিবুল বশরকে খুঁজেছেন। কিন্তু তারা তো বিয়ের দাওয়াতে আসেননি। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনে রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে আসেন।
“বরের গাড়িবহরে খাদিজাতুলের গাড়ি ছিল। তারা তো এক পরিবারের সদস্য। তাই অনেকেই মনে করেছেন, গাড়িতে খাদিজাতুলও এসেছেন। কিন্তু তিনি আসেননি। পরে এ নিয়ে ভুল–বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে।”
তবে বিয়ের অনুষ্ঠানে তাণ্ডবের এই ঘটনায় কোনো আইনি পদক্ষেপ নেবেন না বলে জানান মনজুর।
ফখরুল গ্রেপ্তার
বৈষম্যবিরোধীদের হাতে আটকে পড়া ফখরুল আনোয়ারকে রাতেই পুলিশ খুলশী থানায় নিয়ে যায়। পরে তাকে কোতোয়ালি থানায় দায়ের করা এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) ফয়সাল আহম্মেদ এই তথ্য জানালেও কী নিয়ে মামলাটি তা স্পষ্ট করেননি।
বিবিসি বাংলার জিজ্ঞাসায় তিনি শুধু বলেন, “তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা আছে। তাকে আমরা সেই মামলাতেই আটক করেছি।”