রমজান উপলক্ষে স্কুল ছুটি, তাই মাগুরায় বোনের শ্বশুড় বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল আট বছরের শিশু। বৃহস্পতিবার সেখানেই পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া শিশুটি।
অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিন দিনেও জ্ঞান ফেরেনি তার। শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ভেন্টিলেটর যন্ত্রের সাহায্যে তার শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে। শিশুটির জন্য সবাইকে দোয়া করতে বলেছেন চিকিৎসক।
শনিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, পাশবিক নির্যাতনের ফলে শিশুটির যৌনাঙ্গে ক্ষত রয়েছে। তার গলার আঘাত গুরুতর।
শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক জানিয়ে ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক বলেন, “শরীরে জ্বর আছে এবং নিউমোনিয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ভেন্টিলেটর যন্ত্রের সাহায্যে শিশুটির শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে।”
তিনি বলেন, “আপনারা সবাই শিশুটির জন্য দোয়া করুন।”
শিশুটির উন্নত চিকিৎসার জন্য পেডিয়াট্রিক, সার্জারি, অ্যানেস্থেশিয়া ও গাইনি বিভাগের চার চিকিৎসককে নিয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
শুক্রবার রাতে শিশুটির অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালের গাইনি বিভাগ থেকে তাকে শিশু বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়।

শিশুটির অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেলের শিশু বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়
এর আগে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিশুটিকে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে আনা হয়েছিল। সেখান থেকে দুপুরেই উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ফরিদপুর হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তখন জানিয়েছিল, তাৎক্ষণিক পরীক্ষা করে দেখা গেছে, শিশুটির গলায় একটা দাগ আছে। মনে হচ্ছে, কিছু দিয়ে চেপে ধরা হয়েছিল। শরীরের বেশ কিছু জায়গায় আঁচড় আছে। তার যৌনাঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
শিশুটির পরিবারের সদস্যরা জানান, তাদের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলায়। শিশুটি কয়েক দিন আগে মাগুরা শহরতলীর নিজনান্দুয়ালী গ্রামে তার বড় বোনের (শ্বশুর) বাড়িতে বেড়াতে যায়। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার বোনের শাশুড়ি। পরে শিশুটির মা হাসপাতালে যান।
মেয়েটির মা সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার সময় ওই বাড়িতে মেয়ে একাই ছিল। এ কারণে কে তাকে ধর্ষণ করেছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে বলতে পারছেন না তারা।
তিনি বলেন, “মেয়েকে ঘরের মধ্যে একা পেয়ে কেউ একজন তাকে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায়। পরে অচেতন অবস্থায় তাকে ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”
শিশু ‘ধর্ষণের’ ঘটনায় তিনদিনেও মামলা হয়নি। তবে পুলিশ বলছে মামলার প্রক্রিয়া চলছে।
এ ঘটনায় শিশুটির ভগ্নিপতি সজিব হোসেন (১৮) ও বোনের শ্বশুর হিটু মিয়াকে (৪২) আটক করেছে পুলিশ।
শনিবার মাগুরা সদর থানার ওসি আয়ুব আলী সাংবাদিকদের বলেন, “মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আটক হিটু মিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। আর সজীবকে পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়েছে।”
এদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে শুক্রবার জুমার পর মাগুরা সদরে মহাসড়ক অবরোধ ও থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন ছাত্র-জনতা। এ সময় থানার মূল ফটক ঘেরাও করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি তোলেন। পরে সেনাবাহিনী এসে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
সাড়ম্বরে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হলেও দেশে ধর্ষণের ঘটনা বড়েছে। মহিলা পরিষদের নারী ও কন্যা নির্যাতন বিষয়ক তথ্যে বলা হয়েছে, সদ্য শেষ হওয়া ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১১টি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, চলতি বছর জানুয়ারিতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অন্তত ১১ জন নারী। আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণ ১৮টি। ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে দুটি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে। পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪০টি। এর মধ্যে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আসকের তথ্যানুযায়ী, গত বছর নভেম্বরে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অন্তত সাতজন নারী। ওই মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১২টি, এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণ দুটি। ধর্ষণচেষ্টা সাতটি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে। ডিসেম্বরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৩টি, এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ছয়টি। ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে সাতজনকে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় গত বছর ডিসেম্বরে দেশে এক হাজার ২০৫টি মামলা হয়েছে। আর একই কারণে চলতি বছর জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে এক হাজার ৪৪০টি। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা বেড়েছে ১৯.৫ শতাংশ।
ধর্ষণ মামলা এবং নারীদের আইনি সহায়তা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসছেন মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলীর পর্যবেক্ষণে দেশে ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের পরিস্থিতি মারাত্মক উদ্বেগের।
তিনি বলেন “ভুক্তভোগীকে কেন্দ্র করে যে সাপোর্ট প্রয়োজন, সেটা কিন্তু এখন থানাগুলোতে নেই এবং বেশিরভাগ কেইস কিন্তু থানা পর্যন্ত আসছে না। এই জন্য কিন্ত আপনি অনেক খবর পাবেন না। তৃণমূলের যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলো কিন্তু ভয়াবহ অবস্থা। “
সালমা আলী বলেন, “এখন কিন্তু দুই রকম অপরাধী আছে। একটা হলো স্যাডিস্ট-রেপিস্ট, তারা একটার পর একটা ঘটনা ঘটাচ্ছে। আর অনেক অপরাধী জেল থেকে বের হয়ে গেছে, এরকম কিন্তু অনেক আছে এবং তারা কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট অপরাধ গোষ্ঠী তৈরি করছে। আমি মনে করি পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। “