চীনের অস্ত্রের তুণে দেখিয়ে দিলেন শি

চীনের সামরিক কুচকাওয়াজ। ছবি: সিনহুয়া
চীনের সামরিক কুচকাওয়াজ। ছবি: সিনহুয়া

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডলারের আধিপত্যে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে মোড়লীপনা যুক্তরাষ্ট্র কায়েম করেছিল, তা এখন চীনের কাছে যাই যাই করছে। সমরশক্তিতেও যে এখন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার মতো অবস্থানে চীন, তাই মেলে ধরলেন দেশটির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা শি জিনপিং।

সমরাস্ত্রের এই প্রদর্শনীর জন্য শি জিনপিং উপলক্ষ হিসাবে বেছে নিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানকে হারানোর ৮০ বছর পূর্তির সামরিক কুচকাওয়াজকে। আর বুধবারের এই আয়োজনে পাশে রাখলেন পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে।

সেই সঙ্গে আরও ২৫টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে এই কুচকাওয়াজে সাক্ষী করে শি দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিলেন যে এতদিনের বিশ্বব্যবস্থা এখন বাতিলের পথে, আসছে নতুন বিশ্বব্যবস্থা এবং তার নেতৃত্ব দেবে চীন।

বেইজিংয়ের এই প্রদর্শনী যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বিচলিত, তা তার সোশাল মিডিয়া পোস্টেই বোঝা যাচ্ছে। তিনি অভিযোগ তুলেছেন, চীনের সঙ্গে মিলে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া ষড়যন্ত্র করছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।

প্রদর্শনীতে চীন এমন কিছু সমরাস্ত্র দেখিয়েছে, তা যে তাদের তুণে ছিল, সেটা এতদিন প্রকাশ পায়নি। সেই সমরাস্ত্রের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, এটা আসলে মার্কিন বাহিনীর প্রতি সতর্কবার্তা।

চীনের সামরিক কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়ার সময় শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং উনসহ ২৫ দেশের নেতারা। ছবি: সিনহুয়া

এই কুচকাওয়াজে ছিল এমন সব হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম; ছিল এমন সব ড্রোন, যা আকাশে উড়বে পঙ্ক্ষীরাজের মতো; ছিল এমন ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম।

বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে উড়ে যাওয়া যুদ্ধবিমানের ঝাঁক এবং সারি সারি ক্ষেপণাস্ত্র ও সাঁজোয়া যানের এই কুচকাওয়াজ চীনের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের এক বিপুল সম্ভার মেলে ধরেছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস রিখেছে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এই আয়োজন দেশটির সম্ভাব্য শত্রুদের প্রতি একটি সতর্কবার্তা হিসেবেই দেখা যায়। কারণ এগুলো দেখে মনে হচ্ছে, এগুলো তৈরিই হয়েছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন বাহিনীকে লক্ষ্য করে।

দূরপাল্লার রকেট লঞ্চারগুলো তাইওয়ানের প্রতি বেইজিংয়ের হুমকি আরও বাড়াবে সন্দেহ নেই। বিমান থেকে নামানো যায়, এমন সাঁজোয়া যানগুলো চীনের সক্ষমতা যে ধারণার চেয়েও বেশি, তারই নজির।

এই কুচকাওয়াজের মূল প্রতিপাদ্য ছিল কমিউনিস্ট চীনের সেনাবাহিনী ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’র সক্ষমতাকে মেলে ধরা, যার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে জল, স্থল, অন্তরীক্ষে এই বাহিনী এখন অজেয় হয়ে উঠতে চাইছে।

মার্কিন নৌবাহিনীর জন্য নতুন হুমকি

মার্কিন বাহিনীর প্রতি কুচকাওয়াজের সবচেয়ে জোরালো সতর্কবার্তা ছিল চারটি নতুন মডেলের জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে তিনটি হাইপারসনিক, অর্থাৎ এগুলোর গতি শব্দের গতির চেয়ে কমপক্ষে পাঁচ গুণ বেশি। শুধু তাই নয়, প্রতিরক্ষা ব্যুহ ফাঁকি দিতে এগুলো দিক পরিবর্তন করতেও সক্ষম।

গ্লোবাল পলিসি ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক টিমোথি আর হিথ নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “বেইজিংয়ের এই অস্ত্রগুলো প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত তাইওয়ান এবং ওয়াশিংটনকে একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে আমেরিকান যুদ্ধজাহাজকে ডুবিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে চীনের।”

কুচকাওয়াজের প্রদর্শিত হয় চারটি নতুন মডেলের জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ছবি: সিনহুয়া।

চীন যত বেশি উন্নত হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বিভিন্ন গতি এবং কোণ থেকে শত্রুপক্ষের যুদ্ধজাহাজে নিক্ষেপ করতে পারবে, ততই শত্রুপক্ষের নৌবাহিনীর পক্ষে আক্রমণ এড়ানো বা প্রতিরোধ করা কঠিন হবে।

জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ওয়াইজে-১৯ (YJ-19)। এটি একটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যা সম্ভবত ‘স্ক্র্যামজেট’ ব্যবহার করে, যা ক্ষেপণাস্ত্রকে উচ্চ গতি দিতে সাহায্য করে।

ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির নিরাপত্তা গবেষণা কর্মসূচির প্রধান বিজ্ঞানী এরিক হেগিনবথাম বলেন, “এই ক্ষেপণাস্ত্রটির গতিপথ অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত হতে পারে এবং এটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়ে কম উচ্চতায় উড়তে পারে।

ওয়াইজে-১৯ এবং অন্যান্য নতুন ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

হেগিনবথাম বলেন, মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজের ওপর এদের সম্ভাব্য প্রভাব নির্ভর করবে চীন কতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে, তার ওপর।

পদাতিক বাহিনীর নতুন অস্ত্র

কুচকাওয়াজে বিমান থেকে নামানো যায়, এমন নতুন সাঁজোয়া যান দেখিয়েছে চীন। এসব যানে পেরিস্কোপের মতো ভিউয়ার রয়েছে, যা সৈন্যদেরকে ভেতর থেকে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে।

কুচকাওয়াজে বিমান থেকে নামানো যায়, এমন নতুন সাঁজোয়া যান দেখিয়েছে চীন।

ইউএস আর্মি ওয়ার কলেজের চায়না ল্যান্ডপাওয়ার স্টাডিজ সেন্টারের গবেষণা পরিচালক জোশুয়া অ্যারোস্তেগি বলেন, এই নতুন সাঁজোয়া যানগুলো দেখায় যে চীন তাইওয়ানে বা ভিনদেশের মাটিতে পদাতিক বাহিনী দ্রুত মোতায়েনে জোর দিচ্ছে।

“এমন উন্নত সাঁজোয়া যান শত্রু লাইনের পেছনে নামানো বা বিদেশে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দেওয়ার সময় পদাতিক বাহিনীর শক্তি ও সুরক্ষা অনেক বাড়িয়ে দেবে।”

সাগর ও আকাশ যুদ্ধের ঝলক

মনুষ্যবিহীন দুটি সাবমেরিনও প্রদর্শনীতে দেখিয়েছে চীন। একটি ছিল ৬০ ফুট লম্বা, টর্পেডো-আকৃতির যান, অন্যটির ছিল ছোট মাস্তুল যা যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো সাগর তলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে।

চীন এসব নতুন ডুবোজাহাজ নিয়ে  খুব কম তথ্যই প্রকাশ করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও অন্যান্য নৌশক্তির একই ধরনের জাহাজের সঙ্গে কতটুকু পাল্লা দিতে পারে, তা স্পষ্ট নয়।

তবে অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা জেনিফার পার্কার নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, চীনের তৈরি এমন ডুবোজাহাজের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।

প্রদর্শনীতে চীন এমন কিছু সমরাস্ত্র দেখিয়েছে, তা যে তাদের তুণে ছিল, সেটা এতদিন প্রকাশ পায়নি। ছবি: সিনহুয়া।

“তবে বিভিন্ন ধরনের মডেল দেখে এই ইঙ্গিত মিলেছে যে চীন এই প্রচেষ্টায় অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি অগ্রসর হতে পারে,” যোগ করেন পার্কার।

কুচকাওয়াজে যুদ্ধবিমান, বোমারু বিমান এবং অন্যান্য উড়োজাহাজও গর্জন শুনিয়েছে। ট্রাকে করে ছোট যুদ্ধবিমানের মতো দেখতে বড় ড্রোনও প্রদর্শনীতে ছিল, যা ভবিষ্যতের যুদ্ধে মানবচালিত ও মানববিহীন বিমানের যুগলবন্দি করার চীনা পরিকল্পনার ইঙ্গিতবাহী।

চীন ড্রোনের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপরই বাজি ধরছে। এই ড্রোনগুলো শত্রু বিমান পর্যবেক্ষণ ও আক্রমণ করতে এবং মানবচালিত বিমানকে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে।

জার্মানিতে বসবাসরত চীনা সামরিক বিমান বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেয়াস রুপ্প্রেখট বলেন, “কুচকাওয়াজে বড় ড্রোন ও মানববিহীন বিমানের সংখ্যা এই ক্ষেত্রে চীনের দৃঢ় সংকল্পের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলে। প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে তারা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও শীর্ষস্থানীয় অন্য শক্তির সমতুল্য কিংবা তাদের চেয়েও এগিয়ে।”

পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার

কুচকাওয়াজে সমর বিশারদরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন চীনের পারমাণবিক অস্ত্রগুলোকে। এর মধ্যে ছিল ‘ডিএফ-৩১বিজে’ লেবেলযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র। এটি দেশটির আন্তঃমহাদেশীয় শক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতে পারে।

ডিএফ-৩১ আন্তঃমহাদেশীয় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের একটি সংস্করণ। ছবি: সিনহুয়া।

কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো আঙ্কিত পান্ডা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “লেবেলটি ইঙ্গিত দেয় যে এই ক্ষেপণাস্ত্রটি চীনের ডিএফ-৩১ আন্তঃমহাদেশীয় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের একটি সংস্করণ, যা সাইলো লঞ্চের জন্য অভিযোজিত।”

ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টসের অনুমান, চীনের প্রায় ৬০০টি পরমাণু বোমা রয়েছে। চীন তাদের ক্ষেপণাস্ত্র, ডুবোজাহাজ এবং বোমারু বিমানকে এমন উন্নত করেছে, যা এই ওয়ারহেডগুলো বহন করতে পারে।

আরও পড়ুন