বিশ্বের অভিন্ন ভাষা শেখা শিক্ষার্থী বা ব্যবসায়ীদের কাছে অগ্রাধিকার নয়, তবে খানিকটা প্রয়োজনও বটে। ভাষার জন্য কোনো কোনো জাতি প্রাণ দিয়েছে, কেউ কেউ এখনও লড়ছে। তারপরও ইংরেজি ভাষাটা তো জানা চাই!
তবে এদিক থেকে চীনারা একদম আলাদা। নিজের ভাষাকে বিভিন্নভাবে আঁকড়ে আছে তারা; জাতীয়করণ করেছে নিজেদের ভাষা। তাদের কথা, ‘আমরা আলাদা, আমরা যদি ভাল কিছু জানি বা করতে পারি, মানুষ আমাদেরই ডাকবে’। এর প্রমাণও তারা রেখে যাচ্ছে। বিদেশি ভাষা শেখার প্রতি তেমন কোনো আকর্ষণই তাদের মধ্যে চোখে পড়ে না। তাদের যুক্তি, কেন তারা নিজের ভাষাকে বিসর্জন দিয়ে ধার করা বুলি আওড়াবে।
২০০৮ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আগে বেইজিং কর্তৃপক্ষ পর্যটকদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের ইংরেজি শেখানোর একটি প্রকল্প চালু করেছিলো। লক্ষ্য ছিলো পুলিশ, পরিবহণকর্মী এবং হোটেল কর্মচারীদের অন্তত চলনসই ইংরেজি শেখানো, যাতে তারা পর্যটকদের সঙ্গে সীমিত আকারে কথা চালিয়ে নিতে পারেন। সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল ট্যাক্সি চালকদের।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, ওই চালকের ইংরেজি শেখার লক্ষ্য প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজেই আসেনি। অধিকাংশ চালক এখনও কেবল চাইনিজ ভাষায় কথা বলেন। এমনকি শহরের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কর্মীরাও বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগে হিমশিম খান। ইমিগ্রেশন অফিসাররা বেশিরভাগ সময় অনলাইন অনুবাদ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করেন।
চীনকে বিশ্ব চেনার পর থেকে অধিবাসীদের অনেকেই ইংরেজি শেখার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেছিলো। অনেকেই আশা করেছিলেন এই দক্ষতা তাদের আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে চাকরি পেতে সাহায্য করবে। কেউ কেউ বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে এই ভাষা দক্ষতা কাজে লাগানোর কথা ভেবেছিলেন। কেউ আবার বিদেশে যাওয়ার জন্য।
অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইংরেজি শেখার প্রতি এই উদ্দীপনা কিংবা উন্মাদনা কিংবা আকর্ষণ আর চোখে পড়ে না।
দ্য ইএফ ইংলিশ প্রোফিসিয়েন্সি ইনডেক্স বা ইএফ ইপিআই এর র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, ইংরেজি দক্ষতার ক্ষেত্রে ১১৬টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে চীন বর্তমানে ৯১তম অবস্থানে রয়েছে। চার বছর আগেও এটি ১০০টি দেশের মধ্যে ৩৮তম স্থানে ছিল। অবশ্য ইদানিং খোদ চীনেই কেউ কেউ ওই র্যাঙ্কিংয়ের যথার্থতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন।
অনেকেরই মনে থাকার কথা, কোভিড-১৯ মহামারির সময় চীন তার সীমানা বন্ধ করে দিয়েছিল। কর্মকর্তারা কিংবা ব্যবসায়ীরা তো দূরের কথা, সাধারণ নাগরিকরাও বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেননি। বাকি বিশ্ব যখন খুলতে শুরু করেছিল, চীনের ‘দরজা’ তখনও বন্ধ। ওই সময়ে বিশ্বের ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠেছিলো। বাণিজ্যযুদ্ধ এবং কূটনৈতিক বিবাদ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন এবং কানাডার সঙ্গে সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলে।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, আইনপ্রণেতা এবং বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরাও ইংরেজি শেখার জন্য বরাদ্দ করা সময় কমিয়ে আনার চেষ্টা করেন। শুধু তাই নয়, চীনের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও ইংরেজির গুরুত্ব কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা চোখে পড়ে।
২০২২ সালে এক আইনপ্রণেতা তো প্রস্তাবই দিয়ে বসেন- ঐতিহ্যবাহী চীনা বিষয় শেখানোর জন্য ইংরেজির গুরুত্ব কমানো হোক। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাতে সাড়া দেয়নি।
চীনের শীর্ষস্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেছেন, অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজিকে আর আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না; এটি শেখার প্রতিও তাদের মধ্যে আগ্রহ খুবই কম।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনের অর্থনীতিতে ধীরগতি তাদেরকে আরও সতর্ক করে তুলেছে। বিশেষ করে বিদেশ ভ্রমণ আগের তুলনায় অনেক কমিয়ে দিয়েছে চীনারা; ইংরেজি প্রয়োজন হয় এমন চাকরি নিতেও তেমন একটা আগ্রহী নয়। বরং এখন স্থিতিশীল কিন্তু একঘেয়ে সরকারি চাকরির দিকেই ঝুঁকছেন তারা।
এরসঙ্গে রয়েছে প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা। ইংরেজি শেখার চেয়ে অ্যাপসের মাধ্যমে দ্রুত নিজের ভাষায় তা অনুবাদ করে ফেলাই তাদের কাছে বরং সহজ। এ ধরনের অ্যাপসগুলোও বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে দিনকে দিন।
ইএফ ইপিআই সূচক বলছে, প্রযুক্তি-সচেতন জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াও ইংরেজি দক্ষতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। তাদের অভিমত- প্রযুক্তির ব্যবহার করে যখন একটি ভাষা বুঝে নেওয়া এতোটা সহজ, তখন নতুন ভাষার জন্য সময় ব্যয় কেন?
দ্য ইকনোমিস্ট অবলম্বনে