সংবিধান সংস্কারে মূলনীতিই যাচ্ছে পাল্টে

bangladesh parliament

মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরের বছর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। এরপর গত ৫৩ বছরে সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৭ বার। তাতে সংবিধানের মূল কাঠামোয় খুব একটা কাটা-ছেঁড়া হয়নি।

কিন্তু সংবিধানে প্রণয়নে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবার সংবিধানে যে পরিবর্তনের উদ্যোগ মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়েছে, তাতে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে শাসনতন্ত্র।

ব্যাপক পরিবর্তনের সুপারিশ রেখে সংবিধান সংস্কার কমিশন বুধবার তাদের প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী প্রধানের কাছে তুলে দিয়েছেন।

তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সাংবিধানিক নামই যাচ্ছে বদলে; বদলে যাচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিও। এক কক্ষের সংসদ হয়ে যাচ্ছে দুই কক্ষের, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়াও যাচ্ছে বদলে। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগের বাইরে আবার গঠিত হচ্ছে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে নতুন একটি অঙ্গ।

তিন মাসে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে যুক্তরাজ্যের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ নেতৃত্বাধীন কমিশনের এই সুপারিশ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। তারপরই চূড়ান্ত হবে কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার হবে।

তবে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পেয়েই বলে দিয়েছেন, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ’। এই সংস্কার প্রতিবেদনের মাধ্যমে ‘গণঅভ্যুত্থানের’ একটি সনদ তৈরি হচ্ছে, যা হবে ‘নতুন’ বাংলাদেশের একটা ‘চার্টার’। নির্বাচন হবে, সবকিছুই হবে; কিন্তু চার্টার থেকে সরা যাবে না।

বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেছেন, “একটা ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় আজকে আসলে কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা এই প্রস্তাবগুলো, সুপারিশগুলো রাখছি। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে।”

এই কমিশনের সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকরামুল হক, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকী, আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী, কলামনিস্ট ফিরোজ আহমেদ, মানবাধিকারকর্মী মো. মুস্তাইন বিল্লাহ ও সালেহ উদ্দিন সিফাত।

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবেন।

বিএনপি এরই মধ্যে জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে জুলাই-আগস্টের মধ্যে নির্বাচন চায় তারা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ বলে রেখেছে, তাদের বাদ দিয়ে কিছু করা হলে তা গ্রহণযোগ হবে না।

কিন্তু আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দিতে বাধা দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের।

সংসদ নেই, ফলে সংবিধান সংশোধনে হাত কীভাবে দেওয়া হবে, তার একটি ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। সেটা হচ্ছে গণভোট। 

সুপারিশে বলা হয়েছে, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ হচ্ছে, যেকোনো সংশোধনে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাস হলে, এটি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটের ফলাফল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।

নাম-মূলনীতি

আবার অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধন করলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান এবং সংবিধানের প্রথম ভাগের মৌলিক বিধানাবলি পরিবর্তন বন্ধের যে বিধান সংবিধানে এখন রয়েছে, সেগুলো বাতিলের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।

সংস্কার কমিশন বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে, তাতে বদলে যাবে সংবিধানের শিরোনামও।

সংবিধানে এখন শিরোনাম রয়েছে- “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। তা হবে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’।

সংস্কার কমিশন সংবিধানে ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ এর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ লেখার প্রস্তাব করেছে। তবে ইংরেজি নাম ‘রিপাবলিক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ অবিকৃতই থাকবে।

আলী রীয়াজ বলেন, “বাংলাদেশকে যেভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলা হয়, তার মধ্যে আসলে যে প্রজাতন্ত্রের কথা হয়, সেটায় আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের পরিচিত হওয়া উচিত ‘জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’।”

সংবিধানের বর্তমান চার মূলনীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে গণতন্ত্র রেখে নতুন অন্য চারটি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন। সেগুলো হলো- সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।

এখন পাঁচটি মূলনীতি গ্রহণের বিষয়ে কমিশনের আলী রীয়াজ বলেন, “১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের যে জনআকাঙ্ক্ষা, তার প্রতিফলন হিসেবে আমরা রাষ্ট্রের পাঁচটি মূলনীতি সুপারিশ করছি। সেগুলো হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র।”

মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এগুলোর সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করছে সংস্কার কমিশন।

জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করেছিলেন। এরশাদ তা থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছিলেন। আওয়ামী লীগ মূলনীতিতে ধর্ম নিরপেক্ষতা ফেরালেও সংবিধানের ২ (ক) ধারায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখেই দিয়েছিল।

সংসদ দুই কক্ষের

সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে। এরমধ্যে একটি নিম্নকক্ষ বা জাতীয় সংসদ (ন্যাশনাল এসেম্বলি) এবং একটি উচ্চকক্ষ (সিনেট)। উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর।

নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিতদের নিয়ে। ৪০০ আসন নিয়ে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে। ৩০০ জন সদস্য একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবে। বাকি ১০০ জন নারী সদস্য দেশের সব জেলা থেকে নির্ধারিত ১০০ নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবে। এই ১০০ আসনে কেবল প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।

রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে। তবে তরুণ-তরুণীর বয়সের সীমারেখা দেওয়া হয়নি সুপারিশে।

সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ বছর করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।

নিম্ন কক্ষ বা সংসদে দুজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, যাদের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন। নিম্নকক্ষের সদস্যরা অর্থবিল ছাড়া অন্য যে কোনও বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবে। 

উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে ১০০ জন সদস্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের মনোনয়ের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ জন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে।

এই ১০০ জন প্রার্থীর মধ্যে কমপক্ষে ৫ জন আইন দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে- সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবে। অবশিষ্ট ৫টি আসন পূরণের জন্য রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের মধ্য থেকে (যারা কোনও কক্ষেরই সদস্য ও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন) প্রার্থী মনোনীত করবেন।

কোনো রাজনৈতিক দলকে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্বের যোগ্য হতে হলে- জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের অন্তত ১ শতাংশ নিশ্চিত করতে হবে।

উচ্চকক্ষের স্পিকার সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষের একজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, যিনি সরকারি দলের সদস্য হবেন না।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব নিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, “দুই কক্ষ মিলে যাতে সকলের প্রতিনিধিত্ব থাকে, তার জন্য একইসঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ, কিন্তু সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে উচ্চকক্ষ তৈরি করার জন্য সুপারিশ করেছি।”

জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এমন কোনও আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের আগে আইনসভার উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হবে।

রাষ্ট্রপতি নতুন পদ্ধতিতে, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস

বর্তমানে সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে এলেও সেখানে পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।

কমিশন মনে করে রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের যে পদ্ধতি এখন রয়েছে, তাতে ব্যক্তির ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়। তাই তারা সুপারিশ করেছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবে একটি ইলেকটোরাল কলেজ। এই ইলেকটোরাল কলেজে পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্ন কক্ষের সদস্যদের সঙ্গে ভোটার হবে প্রতিটি জেলা কাউন্সিল ও সিটি করপোরেশন কাউন্সিল। এক্ষেত্রে প্রতিটি জেলা কাউন্সিল থেকে একটি ও সিটি কাউন্সিল থেকে একটি ভোট হবে।

আলী রীয়াজ বলেন, “রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে ব্যক্তির ইচ্ছা প্রতিফলিত হয় বলে আমরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছি। এক ধরনের নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্য দিয়ে যেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, আমরা সেই সুপারিশ করেছি।”

রাষ্ট্রপতি পদে কেউ দুই বারের বেশি থাকতে পারবেন না। রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। নিম্নকক্ষ অভিশংসন প্রস্তাবটি পাস করার পর তা উচ্চকক্ষে যাবে এবং সেখানে শুনানির মাধ্যমে অভিশংসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।

কমিশন রাষ্ট্রপতির কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের কথা সুপারিশ করছে। এই বিশেষ কার্যাবলী কিংবা সংবিধানে উল্লেখিত বিষয় ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করবেন।

প্রধানমন্ত্রী হবেন পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে। কেউ দুই বারের বেশি এই পদে থাকতে পারবেন না, সেই সুপারিশ রেখেছে সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে বলেছে, একজন সংসদ সদস্য একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং রাজনৈতিক দলের প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না।

প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে সংসদে অনাস্থা ভোটের সুযোগ ফেরানোর অংশ হিসেবে ৭০ অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীক কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।

আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়া দরকার, সে ব্যবস্থা করা দরকার। সে কারণে ৭০ অনুচ্ছেদ দ্বারা যাতে প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র সুরক্ষিত না হন, সেজন্য আমরা তার কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেছি।”

নতুন অঙ্গ জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল

কমিশন মনে করে, গত ১৬ বছর বাংলাদেশে ক্ষমতার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য ছিল না। সে কারণে যাতে একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে, সেজন্য রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ ও নির্বাহী বিভাগের দুটি পদ- প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে একটি সাংবিধানিক সংস্থা গঠনের সুপারিশ করেছে।

প্রস্তাবিত কমিশন থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা, দুই কক্ষের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার যারা আসবেন বিরোধী দল থেকে এবং একজন থাকবেন যিনি অন্যান্য দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করবেন।

আলী রীয়াজ বলেন, “এটা প্রায় স্পষ্ট যে প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করা জরুরি এবং যাতে করে তিনি একক ইচ্ছায় নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ দিতে না পারেন, এজন্য এগুলোকে কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করার সুপারিশ করেছে।”

একমাত্র জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তেই রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন, এই সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। তবে কমিশন মনে করে, জরুরি অবস্থার সময়ও নাগরিকদের কোনও অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে না।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের সুস্পষ্ট কাঠামোর পরামর্শ দিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে কমিশন মনে করে যে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা বাছাইয়ের দায়িত্বভার কোনো ব্যক্তি বা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকা ঠিক না, সেজন্য এই দায়িত্ব জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ওপর দেওয়ার সুপারিশ রেখেছে।

আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বাছাইয়ের দায়িত্বভার কোনো ব্যক্তি বা একক প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকা ঠিক নয়। সে কারণে আমরা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে এই বাছাই প্রক্রিয়া অর্পণ করেছি বা সুপারিশ করেছি। আমরা আশা করছি, সেটা সম্ভব হবে।”

কমিশনের সুপারিশে আইনসভার মেয়াদ শেষের ১৫ দিন আগে অথবা ভেঙে দেওয়া হলে তার ১৫ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এই অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য সংখ্যা হবে ১৫ এবং মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৯০ দিন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্ধারণ করবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল। কাউন্সিলের ৯ সদস্যের মধ্যে ন্যূনতম ৭ জন সদস্যের সিদ্ধান্তে কেউ প্রধান উপদেষ্টা হতে পারবেন।

‘ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন’

অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

কমিশনের প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনগুলোর দেওয়া প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। আলোচনার ভিত্তিতেই কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের পথে যাবে সরকার। এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐতকমত্যের ওপর।

আইন উপদেষ্টা বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঠিক করা হবে ন্যূনতম সংস্কার, নাকি প্রত্যাশিত মাত্রায় বিস্তৃত সংস্কার করা হবে। আর ন্যূনতম সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য হলে তখন ন্যূনতম সংস্কারের ক্ষেত্রে কোন কোন সুপারিশ প্রাধান্য পাবে, তা চিহ্নিত করা হবে।”

তবে তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পুরো কাজটা অন্তর্বর্তী সরকার সম্পন্ন করে যেতে পারবে।

পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যেসব সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য হবে সেগুলো বাস্তবায়ন হবে।

তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা যেন বাস্তবায়ন হয়, সেদিকে সব অংশীজন গুরুত্ব দেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সকল অংশীজনের সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া বলেন, “ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা চিরতরে বিলুপ্তি করা জুলাই বিপ্লবের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। আশা করি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জুলাই অভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তা বাস্তবায়ন হবে।”

আরও ৩ কমিশনের প্রতিবেদন

অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের জন্য মোট ছয়টি কমিশন গঠন করেছিল, তাদের মধ্যে বুধবার আরও তিনটি কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

বদিউল আলম মজুমদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন সংস্কার কমিশন ৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো আসনে ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচনের সুপারিশ করা হয়েছে।

কমিশনের সুপারিশের মধ্যে রয়েছে-  নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহার বাতিল, নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বন্ধ করা, ‘না-ভোটে’র বিধান ফিরিয়ে আনা, না-ভোট বিজয়ী হলে সেই নির্বাচন বাতিল করা ইত্যাদি।

রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা সহজ করতে সুপারিশ করেছে নির্বাচনী সংস্কার কমিশিন।

১০ শতাংশ জেলা এবং ৫ শতাংশ উপজেলা বা থানায় অফিস এবং ৫ হাজার সদস্য থাকলেই যেন কোনো দল নিবন্ধন পায়, সেই সুপারিশ করেছে কমিশন।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ১৮৬১ সালের আইন বাদ দিয়ে পুলিশকে যুগোপযোগী বাহিনী হিসাবে গড়ে তুলতে নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে।

সফর রাজ হোসেন নেতৃত্বাধীন এই কমিশন বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও আসামিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা চাওয়ার সুপারিশ করেছে। পুলিশ সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে এই কমিশন।

ইফতেখারুজ্জামান নেতৃত্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন দুদককে দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব থেকে মুক্ত করার দিকে গুরুত্ব দিয়ে ৪৭টি সুপারিশ করেছে।

দুদকে কমিশনারদের সংখ্যা তিনজন থেকে বাড়িয়ে পাঁচজন এবং দুদককে বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছে কমিশন।

চারটি কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ’।

“এই সংস্কার প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা যেটা গঠন করতে চাচ্ছি, তার উদ্দেশ্য হলো- এটা থেকে গণঅভ্যুত্থানের একটা চার্টার তৈরি করা, যা হবে নতুন বাংলাদেশের একটা চার্টার। এটা মতৈক্যর ভিত্তিতে তৈরি হবে। নির্বাচন হবে, সবকিছুই হবে; কিন্তু চার্টার থেকে সরা যাবে না।”

একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির হঠাৎ পুনরুত্থান হয়েছে- মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেখান থেকেই ইতিহাসের সৃষ্টি, আজকের এই অনুষ্ঠান সেই ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা বিচ্ছিন্ন কোনও প্রতিবেদন নয়। আজ যে প্রতিবেদনগুলো আমরা হাতে নিলাম, অবশ্যই এটা আমাদের দেশের জন্য বড় একটি চর্চা। কেউ সেটা অস্বীকার করবে না।”

কমিশনগুলোর সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা একটা নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে সেটার কাঠামো তৈরির কাজ আপনাদের হাতে দিয়েছিলাম কমিশনের মাধ্যমে।

“এটা শেষ নয়, একটা অধ্যায়ের শুরু হলো। স্বপ্ন এবং অভ্যুত্থান পরবর্তী তার যে যাত্রা, সেটা শুরু হলো। এর বড় একটি অংশ এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হবে যে, আমরা কী করতে চাচ্ছি।”

এই সুপারিশমালা বাস্তবায়নে জোর দিয়ে ইউনূস বলেন, “যত দ্রুত পারি, যত বেশি পরিমাণে এটা বাস্তবায়ন করতে পারি, করতে থাকব।

“ভবিষ্যতে যে নির্বাচন হবে, সেটাও হবে এই চার্টারের ভিত্তিতে। সেটাও যেন ঐকমত্যের সরকার হয়, (পরবর্তী সরকারও যেন)  বলে যে, চার্টারকে আমরা ধরে রেখেছি। যত কিছুই হোক, এটা যেন হাত থেকে ছেড়ে না দিই।”

আরও পড়ুন