বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর বাঙালি নিপীড়ন প্রতিরোধে সশস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালে গঠন করেছিল বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় গঠিত এই জাতিরাষ্ট্রের সংবিধানের মূলনীতিতে যুক্ত হয়েছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা। অর্থাৎ রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে আনুকূল্য দেবে না। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ব্যাখ্যা দিতেন- ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। এর মানে হলো ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের মুসলমানি হয় প্রথম। ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সংবিধানে যুক্ত হয় ‘আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’। অর্থাৎ একটি ধর্ম আনুকূল্য পায়। জিয়ার উত্তরসূরি এইচ এম এরশাদ এক ধাপ এগিয়ে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনে সরাসরি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেন সংবিধানে।
২০১১ সালে আওয়ামী লীগ যখন শাসনতন্ত্রে পঞ্চদশ সংশোধন করেছিল, তখন মূলনীতিতে ধর্ম নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনলেও সংবিধানের ২ (ক) ধারায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখেই দিয়েছিল। তা নিয়ে তখন সমালোচনাও হয়েছিল। তবে তার চেয়ে বেশি সমালোচনা উঠেছিল আদিবাসীদের স্বীকৃতি না দেওয়ায়।
গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাত দিয়েছে সংবিধান সংস্কারে। তাদের গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
প্রবাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মার্কিন নাগরিক আলী রীয়াজ নেতৃত্বাধীন ওই কমিশন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরপরই বড় আলোচনা উঠেছে মূলনীতি বদলে দেওয়ার সুপারিশে। ধর্ম নিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চার মূলনীতি পরিবর্তন করে পাঁচটি মুলনীতির সুপারিশ করেছেন তারা। সেগুলো হচ্ছে- সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।
দৃশ্যত এখানে বহুত্ববাদ দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ প্রতিস্থাপন করতে চাইছেন তারা। কিন্তু তা তারা করছেন আবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংবিধানের ২ (ক) ধারায় রেখে দিয়েই। আর তা হলে বহুত্ববাদ কীভাবে হবে, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
আলোচনায় বহুত্ববাদ
বহুত্ববাদ, যার ইংরেজি pluralism, কথাটি নতুন নয়। রাষ্ট্রচিন্তায় পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁসের সূচনা পর্বের পর থেকেই বহুত্ববাদের আলোচিত বিষয়। বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশেও বহুত্ববাদ কথাটি আলোচনায় উঠে আসে নানা সময়ে।
কিন্তু বহুত্ববাদ কি জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের বিকল্প হতে পারে? এই প্রশ্নে বাংলা একাডেমির বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকেই এক কলামে লিখেছিলেন, “কোনো জনগোষ্ঠীকে নিজেদের রাষ্ট্র গঠন করতে হলে সেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য জাতীয়তাবাদ (nationalism) দরকার। চাকমা, রাখাইন, ত্রিপুরা, খাসি, গারো, সাঁওতাল—এগুলো কি এক একটি জাতি (nation)? নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের জন্য এরা কী করতে পারবে?”
অনেকের মুখে বহুত্ববাদের কথাকে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে দুর্বল করার চেষ্টা হিসাবে দেখার কথা তিনি ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ওই কলামে লিখেছিলেন।
তার ভাষ্যে, “বহুত্ববাদের কথা বলে বাংলাদেশের সব কিছুকে শুধু বিভক্ত করতে করতে দুর্বল করে চললে বাংলাদেশের ওপর বৃহৎ শক্তিবর্গের কর্তৃত্ব ও শোষণ বজায় রাখার সুবিধা হয়। সে জন্য এনজিও সিএসওকে তারা অর্থায়ন করে। এই অর্থের জোগান না থাকলে তারা কি এসব করত? এসব করার জন্য তাদের নিজেদের মত ও স্বাধীন চিন্তাশীলতা পরিহার করতে হয়।”
আত্মপক্ষ সমর্থনে অধ্যাপক রীয়াজ বলছেন, মূলনীতির জায়গায় তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অনুসরণ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছিল, “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি।”
কেবল ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে নয়, বাংলাদেশের সব বর্গের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতেই ‘বহুত্ববাদ’ বেছে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
আলী রীয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বহুত্ববাদের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজমের চেয়ে বৃহত্তর মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছি আমরা।
“যেখানে দলিতদের জায়গা হবে, থার্ড জেন্ডার, এথনিক মাইনরিটি (জাতিগত সংখ্যালঘু), রিলিজিয়াস মাইনরিটি, সবার জায়গা হবে। দলিত, থার্ড জেন্ডার থেকে শুরু করে সব ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি।”
তার এই ব্যাখ্যায় কতটা সন্তুষ্ট ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী? বিবিসি বাংলা সেই প্রশ্নও রেখেছিল বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথকে।
উত্তরে তিনি বলেন, ৫৩ বছর ধরে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে আছে, কিন্তু এর তেমন কোনো কার্যকারিতা নেই। তবুও মূলনীতিতে এর উপস্থিতি একটি ‘রক্ষাকবচ’ ও ‘শক্তি’ হিসাবে কাজ করে।
ধর্মনিরপেক্ষতার তুলনায় বহুত্ববাদ ‘অনেক বড় ক্যানভাস’ মেনে নিয়ে কাজল দেবনাথ এটাকে দেখছেন সংশয়ের চোখে।
“তবে মুখের কথা বললেই তো হবে না। যেদিন প্রস্তাবনা দিল, সেদিনই আদিবাসী সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলো। প্লুরালিজম কী হতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গেলো। এই বহুত্ববাদ একটি আইওয়াশ।”
এই বহুত্ববাদ আবার ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো দেখছে ভিন্ন চোখে। তারা বহুত্ববাদ শব্দটিতে আপত্তি জানিয়ে বলেছে, এটা বিভ্রান্তি তৈরি করবে। কেন? সেই ব্যাখ্যায় এই দলগুলো বলছে, ইসলাম একত্ববাদের কথা বলে। ফলে বহুত্ববাদ অনৈসলামিক মনে হতে পারে।
খেলাফত মজলিস বিবৃতি দিয়ে বহুত্ববাদের জায়গায় ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ মূলনীতিতে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। সেই সঙ্গে হুমকি দিয়েছে কোরআন ও সুন্নাহবহির্ভূত কোনও আইন করা যাবে না।
বহুত্ববাদ নিয়ে তাদের এই দাবি খণ্ডন করে আবার সাংবাদিক মারুফ কামাল খান ফেইসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, “বহুত্ববাদকে তাওহিদ বা একত্ববাদের বিপরীত এবং শির্ক-এর সমার্থক বলে কেউ কেউ মতামত দিচ্ছেন। আমার ধারণা, এই মতামত সঠিক নয় এবং এতে অহেতুক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। আমার জানা মতে, তাওহিদ অর্থ একত্ববাদ। ইসলামী শরিয়তে এর বিপরীত শব্দ শির্ক। শির্ক-এর বাংলা তরজমা অংশীবাদ, বহুত্ববাদ নয়। বহুত্ববাদ হচ্ছে প্লুরালিজম-এর বঙ্গানুবাদ।”
রাষ্ট্রধর্ম রয়েই গেল
সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা রেখেও যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাংলাদেশে সুরক্ষা দেওয়া যায়নি, তা আলী রীয়াজ নিজেই স্বীকার করছেন। সেজন্য বহুত্ববাদ এনেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “পরিসংখ্যান বলছে, ইতিহাস বলছে, সেক্যুলারিজম সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দিতে পারেনি। আমরা বরং, অপেক্ষাকৃত অন্তর্ভুক্তিমূলক করার চেষ্টা করছি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিলের সুপারিশের বিরোধিতা করে ফেইসবুকে লিখেছেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দেওয়া এই নয়া সংবিধান প্রত্যাখ্যান করলাম।”
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত আলী রীয়াজ বহুত্ববাদকে এনে আবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে দেওয়া নিয়ে বিবিসি বাংলার প্রশ্নে বলেন, “১৯৮৮ সালের পর রাষ্ট্রধর্মের বিষয়ে ব্যাপক বিরোধিতা কখনোই দেখা যায়নি। আমরা যেসব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করেছি, তাদের প্রায় কেউই এ বিষয়ে কোনো আপত্তি জানায়নি।”
প্রতিবেদন পেশের দিন আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সংবিধান সংস্কারে লাখো মানুষের মতামত নিয়েছেন তারা।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার বিষয়ে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “হাজার হাজার লোক বলছে, এটা (রাষ্ট্রধর্ম) রাখতে হবে। অর্থাৎ এর পক্ষে জনমত আছে। আমরা এই ফ্যাক্টগুলো বিবেচনায় নিয়েছি।”
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার বিষয়ে তাদের ওপর কোনো ভীতি বা চাপ ছিল না বলে জানান আলী রীয়াজ।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসাবে প্রথমে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিকের নাম ঘোষণা হলেও তিনি রাজি না হওয়ায় আলী রীয়াজকে বসানো হয় সেই দায়িত্বে।
শাহদীন মালিক আগে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে যা যা দরকার, তা বর্তমান সংবিধানেই আছে। বিদ্যমান সংবিধান দিয়েই চাইলেই সংকটের সমাধান সম্ভব।”
ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশের পর তিনি বলেন, “সময়ের সঙ্গে ভাষা ও শব্দগত ধারণার পরিবর্তন হয়ে থাকে। শব্দের অর্থের পরিবর্তন হলে যদি বারবার আপনাকে আইন পরিবর্তন করতে হয়… এইটা তো হয় না কোথাও দুনিয়াতে।”
আলী রীয়াজ দাবি করছেন, সুপারিশগুলোর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একনায়কতন্ত্রের পথ বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন তারা।
তিনি বলেন, “এই মূলনীতিগুলো দিয়ে মুজিববাদ নামে একটি আদর্শ তৈরি করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্র জন্ম নেয়। যে সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা যায় না, সেটা একনায়কতন্ত্রের জন্ম দেয়। সাংবিধানিক কাউন্সিলেরর মাধ্যমে সেই পথটা বন্ধ করার কথা বলেছি আমরা।”
অনেকটা তার কথার জবাব হিসাবেই শাহদীন মালিক বলেন, “সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার সংবিধানে ভালো ভালো কথা লেখা হয়েছিল। কিন্তু ৩০ বছরে ফলাফল কী… পুতিন (ভ্লাদিমির পুতিন)!”