দিল্লিই কি এখন শেখ হাসিনাকে সামনে আনছে?

সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা যখন রায়ের দিকে গড়াচ্ছে, তখনই আচমকা বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে একযোগে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার প্রকাশ সবার মনে বেশ কৌতূহল সৃষ্টি করেছে।

সাক্ষাৎকারগুলো যদিও লিখিত ছিল, ফলে সাক্ষাৎকারগ্রহীতারা দিল্লিতে কঠোর গোপনীয়তায় থাকা শেখ হাসিনার দেখা না পেলেও এর পেছনে যে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সায় রয়েছে, তা ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়ার পর দিল্লি তাকে অতিথি হিসেবেই রাখছে। তার মধ্যে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের কিছু সভায় ভার্চুয়ালি অংশ নিচ্ছিলেন। তাতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বেশ বিরক্ত হয়েছিল।

বিসমটেক সম্মেলনের ফাঁকে মোদীর সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বিষয়টি তুলে শেখ হাসিনার মুখ বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। তখন মোদী পাল্টা বলেছিলেন, ব্যক্তি শেখ হাসিনার মুখে বাঁধন আঁটার কোনো সুযোগ তাদের নেই।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার বাঁধ বেশ আলগাই করে দিচ্ছে ভারত সরকার। ফলে বিভিন্ন কর্মসূচিতে তার ভার্চুয়াল অংশগ্রহণও বাড়ছে। মাসতিনেক আগে ভারতে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গেও শেখ হাসিনার সশরীরে সাক্ষাত পর্যন্ত হয়েছে। দিল্লিতে গিয়ে সম্প্রতি মায়ের সঙ্গে দেখা করে গেছেন শেখ হাসিনার আমেরিকা-প্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রতে রাজনৈতিক বন্দিদের মোবাইল ফোন বা অনলাইন অ্যাক্সেস পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক বিধিনিষেধ থাকে, কিন্তু শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়, তা ছাড়া তার খবরের কাগজ বা টিভি চ্যানেল অবাধে সার্ফ করারও সুযোগ আছে। এমনকি তার ব্যক্তিগত ফোনটিও প্রথম দিন থেকে তার কাছেই আছে।

এখন শেখ হাসিনাকে কথা বলার সুযোগ দেয়াটি ভারত সরকারই করে দিচ্ছে বলে মনে করেন দিল্লির থিংকট্যাংক মনোহর পারিক্কর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসে (আইডিএসএ) সিনিয়র ফেলো স্ম্রুতি পট্টনায়ক।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দেখুন আমি এটাকে ঠিক অনুমতি দেওয়া বলব না, কিন্তু এই সাক্ষাৎকারগুলো যে ভারত সরকারের অগোচরে হয়নি তা তো বোঝাই যায়।”

কেন দিচ্ছে- সেই প্রশ্নে স্মৃতি পট্টনায়েক বলেন, তার মূলে আছে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা।

তার ভাষ্যে, “আসলে বাংলাদেশে একটার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ডেভেলপমেন্ট হয়ে চলেছে, যেখানে আওয়ামী লীগ কোনো স্পেস পাচ্ছে না। ঐকমত্য কমিশন সংস্কার নিয়ে কাজ করেছে, জুলাই সনদ পর্যন্ত সই হয়ে যাচ্ছে – অথচ সেখানে আওয়ামী লীগের কোনো ভূমিকাই নেই।

“কিন্তু আওয়ামী লীগ হলো সে দেশের এমন একটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি যাদের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিকভাবে সুসম্পর্ক। সেই দলটি যখন সেখানে মুখ খোলারই সুযোগ পাচ্ছে না তখন ভারতকে তো এটুকু করতেই হবে, শেখ হাসিনাকে বলতে দিতে হবে।”

ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার রীভা গাঙ্গুলি দাসও মনে করেন, শেখ হাসিনার এই সব বক্তব্য আসলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার উদ্দেশেই। সামনেই নির্বাচন আসছে, ফলে হাতে খুব একটা সময়ও আর নেই।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দলটার শীর্ষ নেতারা দেশে নেই, সামনের নির্বাচনে তারা লড়ারও সুযোগ পাচ্ছে না, এই পরিস্থিতিতে ভারতে থাকা শেখ হাসিনার পক্ষে যতটুকু যা করা সম্ভব, তিনি সেটাই করছেন। তার হোস্টরাও তাতে আপত্তি জানাচ্ছে না।”

আবার ভারত শেখ হাসিনাকে ব্যবহার করছে, এমন ধারণাও রয়েছে কারও কারও। ভারতের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে বা প্রকাশ্যে যেগুলো বলা সম্ভব নয়, তার অনেক কথাই শেখ হাসিনার মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বলদাস ঘোষাল।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমি তো বলব শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্যে দিয়ে ভারতই একটু আক্রমণাত্মক অবস্থান নিতে চাইছে।

“আসলে বাংলাদেশে সম্প্রতি এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যেটাকে দিল্লি পরিষ্কার ভারত-বিরোধী পদক্ষেপ বলে মনে করছে। যেমন, সে দেশে পাকিস্তানের সামরিক জেনারেল বা সরকারি কর্মকর্তাদের ঘন ঘন সফর – কিংবা ধরা যাক সেভেন সিস্টার্স নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য। আবার দিল্লিতে অনেকের এমনও ধারণা আছে যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত নানা কারণে চাপে আছে বলে বাংলাদেশ বোধহয় সেই কোণঠাসা অবস্থারই সুযোগ নিয়ে কিছু ব্রাউনি পয়েন্ট স্কোর করতে চাইছে।”

এই পটভুমিতে বাংলাদেশকে পাল্টা চাপে ফেলার চেষ্টাতেই ভারতে নীতিনির্ধারকদের একটা অংশ শেখ হাসিনাকে সুকৌশলে কাজে লাগাচ্ছেন বলে বলদাস ঘোষালের ধারণা।

“এতে করে দুটো উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে। প্রথমত, শেখ হাসিনার কথাগুলো বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব ফেলে বা সরকার কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায় সেটা পরখ করে দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের হতোদ্যম নেতাকর্মীদেরও একটা বার্তা দেওয়া যাচ্ছে, যে দেখো শেখ হাসিনা দলের হাল ঠিকই ধরে রেখেছেন এবং ভারতও পুরোপুরি তার পাশেই আছে।”

লন্ডনভিত্তিক লেখক ও জিওপলিটিক্যাল অ্যানালিস্ট প্রিয়জিৎ দেবসরকার মনে করেন, শেখ হাসিনা ভারতে পা রাখার পরই তাকে যেভাবে কঠোর গোপনীয়তা আর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছিল, তার সঙ্গে কোভিড লকডাউনের অনেক মিল আছে। আর এখনকার ঘটনা লকডাউন তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া।

খুব শিগগিরই আরো কিছু গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার একই ধরনের ‘সাক্ষাৎকার’ বের হবে, এমন আভাস বিবিসি পেয়েছে।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে যদি ভিডিও ক্যামেরার সামনে বসে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যায়, তাহলেও বোধহয় অবাক হওয়ার কিছু নেই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads