‘অন্তর্বর্তী সরকার কখন কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা আমরা জানতে পারছি না’- গত মাসেই হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। অথচ এই প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে মুহাম্মদ ইউনূসকে পছন্দ করেছিলেন তারাই। আবার সেই সরকারের তিনজন উপদেষ্টা সরাসরি আন্দোলনেরই মুখ।
এক মাস পর এখন সরকারের ভাষ্যও এমন হতে পারে যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কী করছে, তা সরকার জানতে পারছে না। অন্তত জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র ঘোষণা নিয়ে একথা বলা যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রোববার সংবাদ সম্মেলন করে মঙ্গলবার শহীদ মিনারে সমাবেশ করে এই ঘোষণাপত্র উপস্থাপনের ঘোষণা দেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়, এবিষয়ে তারা অন্ধকারে রয়েছেন। এর সঙ্গে সরকারের কোনও সম্পর্ক নেই।
এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের কর্মসূচি ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে এগিয়ে চললে তার একদিন আগে আকস্মিকভাবেই জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ঘোষণা দেন, সরকারই দেবে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষণাপত্র নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সরকারের এই পদক্ষেপ এল। প্রেস সচিব জানালেন, এবিষয়ে সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক দলসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করে মতৈক্যের ভিত্তিতে একটি ঘোষণাপত্র অচিরেই তৈরি করবে।
এর কয়েক ঘণ্টা পর জরুরি বৈঠক ডেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গভীর রাতে সংবাদ সম্মেলন করে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা স্থগিত করে।
গত দুদিনের ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকারের দূরত্বকে আরও স্পষ্ট করেছে, যা গত কয়েকমাস ধরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছিল।
রক্তাক্ত অভ্যুত্থান পেরিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আলোচনা যখন শুরু হয়, তখনই বৈষম্যবিরোধী ছা্ত্র আন্দোলন প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে মুহাম্মদ ইউনূসের নাম ঘোষণা করে। তবে তিনি ছিলেন বিদেশে, তার অপেক্ষায় তিন দিন সরকারশূন্য অবস্থায় ছিল দেশ। গত ৮ আগস্ট দেশে ফিরে ছাত্রনেতাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন তিনি।
ইউনূস দেশে ফিরেই শেখ হাসিনাকে হটানোর অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য তরুণদের অভিবাদন জানিয়েছিলেন। সরকার গঠনের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছিলেন, ছাত্ররাই তার সরকারের নিয়োগকর্তা। অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের পরিবেষ্টিত হয়ে নানা অনুষ্ঠানেও ইউনূস বলে যাচ্ছিলেন, দেশ চালাবে তরুণরাই।
এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতের অমিল ঘটতে থাকলেও সরকারের সঙ্গে তেমন কোনও দূরত্ব দেখা যাচ্ছিল না।
অক্টোবরে এসে রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিনের অপসারণের দাবি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তোলার পর প্রথম দূরত্ব দেখা যায়। তখন রাজনৈতিক দলগুলো বিপক্ষে অবস্থান নিলে মৌন থেকে তাদের প্রতিই সমর্থন জানিয়ে যায় সরকার।
নভেম্বরের শুরুতে এসে ইউনূস যখন তার সরকারে উপদেষ্টা হিসাবে ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ফারুকীকে নেন, তখন তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাছ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’দের উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এই দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়ে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম ফেইসবুকে লেখেন, “খুনি হাসিনার তেলবাজরাও উপদেষ্টা হচ্ছে!”
দুই উপদেষ্টাকে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের চড়াও হওয়ার প্রতিবাদ জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহও। তিনি ফেইসবুকে লেখেন, “বশির-ফারুকীকে উপদেষ্টা করার প্রতিবাদ সভা থেকে গ্রেপ্তার করার ঘটনা চরম ফাইজলামি। এগুলা ভণ্ডামি।”
তখন সরকারের উদ্দেশে হুমকিও দিয়েছিলেন হাসনাত; লিখেছিলেন, “আপনেরা হাসিনা হয়ে উঠার চেষ্টা কইরেন না। হাসিনারেই থোরাই কেয়ার করছি, উৎখাত করছি। আপনেরা কোন হনু হইছেন?”
সরকারের সঙ্গে মতভেদের মধ্যে জুলাইয়ের মতো ফেইসবুকে নিজের প্রোফাইল পিকচার আবার লাল করতে শুরু করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
তখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “সরকার শুধু ছাত্রদের মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে গেছে, তা না। সরকার আন্দোলনের সকল পক্ষেরই মুখোমুখি অবস্থান নিচ্ছে। একটা সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু কারও সাথে কথা হয় না। শপথ হওয়ার পর আমাদের জানতে হয়, কে হচ্ছেন উপদেষ্টা।”
সরকারের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধীদের দূরত্ব দেখে আন্দোলনে থাকা অন্যরা হতাশার পাশাপাশি উদ্বেগও প্রকাশ করেছিলেন। এক মাস পর তাদের সেই উদ্বেগ আরও বাড়ার ক্ষেত্রই তৈরি হলো।
ফেইসবুকে ‘হাইপ’ তোলার একদিন পর রবিবার জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেন, ৩১ ডিসেম্বর তারা ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’ ঘোষণা করবেন। তাতে দেশে ‘মুজিববাদী সংবিধানের কবর’ রচিত হবে এবং আওয়ামী লীগ দল হিসেবে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়বে।
সংবাদ সম্মেলনে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “এই ঘোষণাপত্র ৫ই আগস্টেই হওয়া উচিৎ ছিল, না হওয়ার ফলে ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিগুলো ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। যে গণ অভ্যুত্থানটি হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে মানুষ মুজিববাদী সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তার একটি লিগ্যাল ডকুমেন্টেশন থাকা উচিৎ।”
সেদিনই সাংবাদিকদের প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, “আমরা এটিকে প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ (বেসরকারি উদ্যোগ) হিসেবেই দেখছি। সরকারের সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”
কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শহীদ মিনারে তাদের কর্মসূচি নিয়ে এগোতে থাকে। সোমবার আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। তারপর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “মঙ্গলবারের ঘোষণাপত্রে এমন একটা সীমারেখা আগামী দিনের সরকারকে দিয়ে যাওয়া হবে, তার বাইরে যেন কোনো সরকার যেতে সাহস না করে।”
তারপর রাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
“জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে।”
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দিতে চাইলেও প্রেস সচিব সরকারের পক্ষে ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার কথা বলেন এবং তা দেওয়ার আগে সবার সঙ্গে আলোচনার কথাও বলেন তিনি।
শফিকুল বলেন, “গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হবে। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিত, ঐক্যের ভিত্তি ও জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত হবে।”
সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে বলে জানান তিনি।
তার এই বক্তব্যের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা এখন কী করবে, সেই কৌতূহল জাগে সবার মধ্যে। এর আগে বিএনপি ছাড়াও বৈষম্যবিরোধীদের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও তাদের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “যখন বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজন, তখন বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করাসহ বিভিন্ন বক্তব্য এবং এ ধরনের উদ্যোগ অনাস্থা–বিভেদ বাড়াবে।”
প্রেস সচিবের সংবাদ সম্মেলনের পরপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জরুরি বৈঠকে বসেন। কয়েক ঘণ্টার বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে মুখ্য সমন্বয়ক হান্নান মাসউদ বলেন, তারা মঙ্গলবার সমাবেশ করলেও ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করছেন না। সেই ঘোষণাপত্র সরকারই দেবে।
৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনকারীদের অনেকেই ‘বিপ্লব বেহাত’ হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। এখন বৈষম্যবিরোধীরা ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা থেসে দাঁড়ানোয় অন্তর্বর্তী সরকারই দেবে ‘অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’।