যেভাবে প্রতিরোধযোগ্য হলো একটি মারণব্যাধি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ইবোলা ভাইরাস পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে এক আতঙ্কের নাম। ২০১৪ সালে এ ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া এবং গিনিতে ১১ হাজারের বেশি প্রাণহানি ঘটেছিল।

কঙ্গোতে ১৯৭৬ সালে ভাইরাসটির প্রথম পাওয়া গেলেও এটি ছিল ইবোলা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর নজির।

ইবোলা এমন একটি ভয়ঙ্কর ভাইরাস যার চিকিৎসা না হলে শরীরের ভেতরে এবং চোখ, নাক, মুখ ও মলদ্বারের মাধ্যমে রক্তক্ষরণ হয়।

তবে আগের থেকে এর প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর হার ২৫ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়েছে যা পরিস্থিতি এবং প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর মোকাবেলার ওপর নির্ভর করে।

২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে এর প্রাদুর্ভাবে বৈশ্বিক সংক্রামক রোগ মোকাবেলার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাঁক বের হয়ে আসে। আর সেটা হলো একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের অনুপস্থিতি।

মহামারির শুরুতে ইবোলার চিকিৎসা বা প্রতিরোধে কোনো ওষুধ বা টিকা অনুমোদিত ছিল না; এমনকি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্যও প্রস্তুত ছিল না। তাই অনেকেই ভাবছিলেন দ্রুততার সঙ্গে যতটা নিরাপদে সম্ভব এ বিষয়ে গবেষণা নৈতিকভাবে জরুরি।

একজন জীববিজ্ঞানী ও মহামারি বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে আমি ইবোলা ভ্যাকসিন পরীক্ষা ল্যাবরেটরি কার্যক্রম সমন্বয় করতে গিনি যাই।

ভ্যাকসিনটি নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিশ্চিতে প্রায় ১০ হাজার লোকের ‍ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। দুই বছর ধরে চলা এ পরীক্ষায় পাঁচশ’র বেশি বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যকর্মী অংশ নেন।

তবে এ বিষয়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল আমার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে। যার কথায় আমি আরও দৃঢ় হতে পেরেছিলাম। সে বলেছিল, “ওদের তোমাকে প্রয়োজন। তুমি না গেলে কে যাবে?”

আমি যখন টিকার কার্যকারিতা যাচাই পরীক্ষাগার পরিচালনা করছিলাম তখন সেখানকার লজিস্টিক সীমাবদ্ধতাসহ মানসিক পীড়নের মতো সংকট মোকাবেলায় তার এই উৎসাহ শক্তি জুগিয়েছে।

এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হয়েছিল; যেখানে হাজার হাজার নমুনা তৈরি করা যায়। ভ্যাকসিন সরবরাহের জন্য অতিশীতল ফ্রিজ প্রয়োজন ছিল যার তাপমাত্রা মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে হবে। তবে সে দেশে এমন কোনো ফ্রিজই ছিল না।

এছাড়া আমাদের গিনির জনগণের মধ্যে, যার সেদেশের চিকিৎসক ও জ্ঞানীগুণী জনদেরও ভ্যাকসিন সম্পর্কে দ্বিধা দূর করতে হয়েছিল। সেইসঙ্গে এমন একটি রোগ যা মৃত্যুদণ্ডের সমান তাতে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ও ছিল।

শুরুতে প্রথম সারির কর্মী এবং ইবোলা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিদের ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছিল; যা সংক্রমিতদের চারপাশে একটি সুরক্ষা বৃত্ত তৈরি করতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল।

তবে একজন মাঠ সমন্বয়কারী হিসেবে প্রাদুর্ভাবের মাঝখানে ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা চালানোর চ্যালেঞ্জগুলো আমি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি।

এছাড়া গবেষণার সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মেদসাঁ সঁ ফ্রঁতিয়ার, এপিসেন্টার এবং স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে। এই সমন্বয় প্রচেষ্টাগুলো স্বাস্থ্য সঙ্কটের সময় দ্রুত পরিবর্তন ও কার্যকর গবেষণার গুরুত্বও তুলে ধরেছে।

২০১৫ সালের ১৮ অগাস্ট ট্রায়ালের প্রাথমিক ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ট্রায়ালে ভ্যাকসিন ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি বাঁক পরিবর্তনের মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়। ভ্যাকসিনের প্রায় নিখুঁত কার্যকারিতা নতুন আশা জাগায়।

আজ সিয়েরা লিওন সেই ভ্যাকসিনটিকে এরভেবো  (Ervebo) নাম দিয়ে জাতীয় প্রচারাভিযান শুরু করেছে। প্রচারাভিযানে প্রথম পর্যায়ে দেশটির ১৬টি জেলায় ২০ হাজারে ফ্রন্টলাইন কর্মীকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এদের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, লোক চিকিৎসক (কবিরাজ), কমিউনিটি স্বাস্থ্য ও সামাজিক কর্মী, ল্যাবরেটরি কর্মী, মোটরসাইকেল ট্যাক্সি চালক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। অর্থাৎ ভবিষ্যতে আবার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তা মোকাবেলায় যারা সম্পৃক্ত থাকবে তারা সবাই।

এরভেবো কীভাবে কাজ করে?

মার্ক কোম্পানি উদ্ভাবিত এরভেবো এক ডোজের একটি ভ্যাকসিন। এটি পরিবর্তিত একটি ভাইরাস ব্যবহার করে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে যা ইবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভাইরাস শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয়করণে প্রস্তুত করে।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, এটি সবচেয়ে মারাত্মক জায়রে ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ৯৫% এরও বেশি কার্যকার।

২০১৮-২০২০ সালের ইবোলা মহামারির সময় কঙ্গোতে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদনে টিকাটি ব্যবহৃত হয়েছিল। এই অনুমোদনের আওতায় একটি চিকিৎসা পণ্যকে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইউরোপীয় মেডিসিনস এজেন্সি এবং আফ্রিকান মেডিসিনস এজেন্সির মতো সংস্থাগুলোর অনুমোদন না থাকলেও ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হয়।

ভ্যাকসিনটি বুরুন্ডি, উগান্ডা, দক্ষিণ সুদান এবং রুয়ান্ডায় প্রতিরোধমূলক টিকা কর্মসূচির আওতায় স্বাস্থ্যসেবা ও ফ্রন্টলাইন কর্মীদের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।

এরভেবো এখন ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, বিশেষ করে জায়ের স্ট্রেইনের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে। তবে এর সফলতা নির্ভর করবে সমভাবে প্রয়োগে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উপর।

চ্যালেঞ্জগুলো কী কী

তবে টিকা কর্মসূচিতে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সীমিত ভ্যাকসিন সরবরাহ, প্রত্যন্ত অঞ্চলে লজিস্টিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও ভুল তথ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে টিকা নিতে অনীহা।

এই বাধাগুলো সমাধানে সরকার, স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সম্প্রদায়গুলির মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। এছাড়া আফ্রিকায়  ভ্যাকসিন উৎপাদন করা একটি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হওয়া উচিত; যা  সরবরাহ এবং বণ্টন বিষয়ে আক্রান্ত দেশগুলোকে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ দেবে।

ভ্যাকসিন কি ইবোলার সমাপ্তি আনতে পারবে?

ইবোলা মোকবেলায় এরভেবো একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলেও এটি এককভাবে ইবোলা নির্মূল করতে পারবে না। কারণ ভাইরাসটি বাঁদুড়সহ বিভিন্ন প্রাণী উৎসে থাকতে সক্ষম এবং সেখান থেকে  মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। এর মানে দাঁড়ায় টিকাদান একটি বিস্তৃত কৌশলের অংশ হিসেবে থাকবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যবেক্ষণ, প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে করণীয় এবং সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার সমন্বয় অপরিহার্য।

এরভেবোর সাফল্য এমপক্সের মতো অন্যান্য সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় একটি মডেল সরবরাহ করে। যার ফলে এমপক্সের প্রাদুর্ভাবের সময় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রোগটির একটি কার্কর নতুন টিকার সূচনা ঘটাতে পারে।

লিখেছেন প্রফেসর ইয়াপ বুম, সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিকের ইনস্টিটিউট অব পাস্তর বাংগুই এর নির্বাহী পরিচালক এবং এপিসেন্টারের সাবেক প্রতিনিধি।

সিএনএনে পুনঃপ্রকাশিত: অনুবাদ ও সম্পাদনায় মাহবুবা ডিনা

আরও পড়ুন