বাংলাদেশে গোটা ফেইসবুক এখন ডিমময়; নিউ ইয়র্কে ডিমের দাম এখন কত, ডিম মারলে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে সাজা কী, সেই খবর দিচ্ছে সংবাদমাধ্যমও।
নিত্য দিনের আহার্য ডিম নিয়ে নতুন করে এই চর্চার শুরু সোমবার নিউ ইয়র্কে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরের টার্মিনালের ফটকে বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানকারীদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষনেতা আখতার হোসেনের ওপর ডিম হামলার পর।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যাওয়া প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী দলের একজন আখতার। আখতারে ওপর ডিম বর্ষণ হলেও তা থেকে রক্ষা পেয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এনসিপির নেতা তাসনিম জারা। তবে ডিম থেকে বাঁচলেও গালাগাল থেকে বাঁচতে পারেননি তারাও।
গত বছর অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বিক্ষোভ থেকে এই ডিম আর গালি বর্ষণ হয়। আর তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সব মহলেই এখন আলোচনার ঝড় বইছে।
বাড়তি দরের জন্য নিউ ইয়র্কের ডিম বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনায়। গত ফেব্রুয়ারিতে এক ডজন ডিমের দাম ছিল ৮ ডলার ছাড়িয়ে গেলে তা নিয়ে বেশ হৈ চৈ পড়েছিল দেশটিতে। এখন একটু কমে এসেছে দাম। তাতেও ৪-৫ ডলারের কমে ডিম মেলে না। তাতে দেখা যাচ্ছে, একটি ডিমের দাম পড়ছে ৫০ টাকার মতো।
সেই ৫০ টাকা দরের একটি ডিমই ফেটেছে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতারের পিঠে। বিদেশি ডিম বলে কথা!
বছর খানেক আগে বাংলাদেশেও ডিম নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছিল একের পর এক। তবে দেশি ডিম বলেই হয়ত এখনকার মতো শোরগোল আখতারের সঙ্গীরা তোলেননি, এমন ভাবতে পারেন কেউ।
বরং ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রীদের ওপর ডিম নিক্ষেপের সেই ঘটনাগুলোয় বগল দাবাচ্ছিলেন যারা, তারাই এখন ডিমের সমালোচনায় মুখর।

গত বছর অভ্যুত্থানের পরপরই ঢাকার আদালতে ডিম হামলার শিকার হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। তারপর ডিম হামলা হয় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ওপরও। ডিমের হাত খেকে বাঁচেননি সাবেক মন্ত্রী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুও।
ময়মনসিংহ সীমান্ত থেকে আটকের পর সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্তের ওপরও ডিম হামলা হয়েছিল। মেহেরপুরের আদালতে ডিম নিক্ষেপ হয়েছিল সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ওপর। মানিকগঞ্জের আদালতে ডিম হামলার মুখে পড়েন সঙ্গীতশিল্পী, সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম।
সেই ডিম আর এই ডিমের দেশি আর বিদেশি, এমন পার্থক্য যেমন টানা যায়। তেমনি প্রতিক্রিয়ায়ও দেখা যাচ্ছে ভিন্নতা। তখন ডিম হামলার পর অভ্যুত্থানকারীরা তা দেখছিলেন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে, আওয়ামী লীগ সমর্থকরা দেখছিলেন ভিন্ন চোখে। এখন ডিম হামলা দেখে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা উৎফুল্ল, আর অভ্যুত্থানকারীরা ক্ষিপ্ত।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে যাবেন শুনেই সোমবার জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে বিক্ষোভ ডেকেছিল প্রবাসী আওয়ামী লীগ সমর্থকরা।
স্থানীয় সময় সোমবার বিকাল ৩টার পর তারা বিমানবন্দরে নামেন। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট নিয়ে অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে গেলেও বিএনপির মহাসচিব ফখরুল, এনসিপি নেতা আখতার ও জারা, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের পড়ে যান আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে।
তাদের দেখেই গালাগালি শুরু করেন বিমানবন্দরের ৪ নম্বর টার্মিনালে জড়ো হওয়া আওয়ামী লীগ সমর্থকরা। গালিগালাজের মধ্যে পরপর কয়েকটি ডিম ছুড়ে মারা হয়। একটি ডিম আখতার হোসেনের পিঠে লেগে ফেটে যায়।
সোশাল মিডিয়ায় আসা নানা ভিডিওতে দেখা যায়, ডিমময় কোট নিয়েই গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আখতার। শশব্যস্ত হয়ে ছুটছেন ফখরুল, জারাও। এই সময় কাউকে বলতে শোনা যায়- ‘আপারে (জারা) ডিম মারিস না’।
জামায়াতের সমর্থকরা অবশ্য তাদের নেতা তাহেরকে বেষ্টনি তৈরি করে ডিমের হাত থেকে বাঁচায়।
ডিম নিক্ষেপকারী হিসাবে ভিডিওতে দেখা যাওয়া ব্যক্তি মিজানুর রহমান যুবলীগের সমর্থক বলে জানা গেছে। তাকে নিউ ইয়র্ক পুলিশ গ্রেপ্তার করছে, এমন ভিডিও-ও এসেছে সোশাল মিডিয়ায়।
তাসনিম জারা এরপর ফেইসবুকে লেখেন, “আজ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পর আমাদের দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর হামলা হয়েছে। তাকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হয়েছে, গালিগালাজ করা হয়েছে।”
আখতার নিজেও ফেইসবুকে লিখেছেন এনিয়ে, তাতে তিনি বলেছেন, ডিমের ভয় তিনি করেন না। “এই প্রজন্ম হাসিনার ছোড়া বুলেটে ভয় পায় নাই৷ ওদেরই ছোড়া ডিমে ভয় পাওয়ার প্রশ্নই আসে না,” বলেছেন তিনি।
এদিকে নিউ ইয়র্কে আখতারের পিঠে ডিম ফাটানোর খবর শুনে দেশে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এনসিপির নেতা-কর্মীরা। তারা বিক্ষোভের ডাক দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে শেখ হাসিনার ছবিতে ডিম ছুড়ে নিউ ইয়র্কের ঘটনার জবাবও দেওয়া হয়।
সেই সঙ্গে এনসিপি নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে আরেকটি বিষয় তোলে। তাহলো, প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হয়ে আখতাররা যখন লাঞ্ছিত হলেন, তখন সরকারের পদক্ষেপ কী ছিল? দূতাবাস কর্মকর্তাদের ভূমিকাই বা কী ছিলো?
বিমানে ওঠার পর আখতারদের সঙ্গে ইউনূস করমর্দন-শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন, নিউ ইয়র্কে নামার পর তাদের অরক্ষিত রেখে তিনি কেমন করে একা চলে গেলেন হোটেলে, সেই প্রশ্নও তোলা হয়েছে।

এমন সব অভিযোগের জবাবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ‘গভীর দুঃখ’ প্রকাশ করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা ও তার সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতাদের সফরকে ঘিরে সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগে থেকেই একাধিক সতর্কতামূলক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছিল।
“জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে প্রতিনিধি দলকে প্রথমে নির্ধারিত ভিভিআইপি গেট দিয়ে প্রবেশ করানো হয় এবং বিশেষ সুরক্ষিত পরিবহন ব্যবস্থায় তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ এবং শেষ মুহূর্তের ভিসাজনিত জটিলতার কারণে প্রতিনিধি দলকে বিকল্প পথে যেতে হয়।”
অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ভিভিআইপি প্রবেশাধিকার এবং রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা দেওয়ার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করা হলেও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল বলেই তারা ঝুঁকির মুখে পড়েন, বলা হয় বিবৃতিতে।
এতে আরও বলা হয়, “ঘটনার পর প্রধান উপদেষ্টা ও সরকারি প্রতিনিধি দলের সব সদস্যের নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার করা হয়েছে। তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার।”
এরপর আখতাররা নিরাপত্তা যদি পানও, তাতেও ডিমের আলোচনা চাপা পড়ছে না। সেই আলোচনায় ডালপালা গজাচ্ছে।
সোশাল মিডিয়ায় অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এর দায় ইউনূস সরকার এড়াবে কীভাবে? গত এক বছর ধরে দেশে ‘মব’কে আশকারা দিয়ে তারা মাথায় তুলেছেন, নানা কথামালায় একে স্বাভাবিক করে তুলেছেন, ফলে এখন তা বুমেরাং হলে দোষ কার?