জীবিকার জন্য চাকরিটা করতেই হয় অধিকাংশ মানুষের; আর সেই চাকরির বাজারে কোনটির চাহিদা বেশি তাও জানতে হয়। কারণ চাহিদা যেখানে বেশি সেখানে বেতনও বেশি। আর যে পেশায় বেশি বেতন, সেটাই আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক।
বিশ্বের আর সব অঞ্চলের মতো ইউরোপেও একেক পেশায় একেক রকম আয়। কোন পেশায় আয় বেশি, আর বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে আয়ের ক্ষেত্রে কোন পেশা এগিয়ে, তা তুলে এনেছে ইউরোনিউজ। চাকরির বিভিন্ন ডেটা বিশ্লেষণ করে খাতভিত্তিক এবং দেশভিত্তিক উভয় তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে এক প্রতিবেদনে, যা সবার ক্যারিয়ার বাছাই করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে বলে মনে করা হয়।
যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের চাকরির বাজারের ২০২৪ সালের মে থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এতে।
পেশাভিত্তিক আয়ে এগিয়ে চিকিৎসকরা
চিকিৎসা: মেডিকেল কনসালটেন্ট, রেডিওলজিস্ট, অর্থোডন্টিস্ট ও ডেন্টিস্টরা সব দেশেই সর্বোচ্চ বেতনভোগীর তালিকায় ররেছে। মেডিকেল টেকনিশিয়ান, মেডিকেল তথ্য সেবাদাতা, নার্সিং পেশায় আয়ও কম নয়। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে এই পেশার মানুষদের আয় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। যেখানে শীর্ষ ২০টি সর্বোচ্চ বেতনভোগী চাকরির প্রায় অর্ধেকই চিকিৎসক, বিশেষ করে দন্ত চিকিৎসক। ফ্রান্সেও শীর্ষ বেতনভোগীদের তালিকায় রয়েছে চিকিৎসকরা।
নির্বাহী ও ব্যবস্থাপক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যবস্থাপনা কৌশলী, প্রকল্প পরিচালক, তথ্য প্রযুক্তি পরিচালকের মতো পদখারীরা সব দেশেই ভালো বেতন পাযন। বিপণন, ব্যাংকিং কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ ব্যবস্থাপনার মতো খাতে এই পদগুলো পাওয়া যায়।
তথ্য প্রযুক্তি: সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ইনফরমেশন ডিজাইন ও ডকুমেন্টেশন এবং আইটি খাতে থাকা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ডেটা ইঞ্জিনিয়ার এবং পরামর্শকরা ভালো বেতন পান, বিশেষ করে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসে।
বিপণন: এই খাতে নিচের পদগুলোতে বেতন কম হলেও যতই ওপরে যাওয়া যায়, বেতন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। বিক্রয় পরিচালক, বিক্রয় প্রধান এবং নির্বাহী ভালো বেতন পান। জার্মানি ও ফ্রান্সে এমনও দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞরা তথ্য প্রযুক্তি কিংবা ব্যবস্থাপনা খাতের চাকরীজীবীদের মতোই উচ্চ বেতন পান।
কর আইনজীবী/পরামর্শক: কর আইনজীবী, শ্রম আইনে অভিজ্ঞ আইনজীবী, আর্থিক খাতের পরামর্শকরা বেশ ভালো রোজগার করেন, বিশেষ করে জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে।

কোন দেশে কী হাল
জার্মানি: জার্মানিতে কর আইনজীবী বা পরামর্শকরা সবচেয়ে বেশি আয় করেন। তাদের বার্ষিক গড় বেতন ১ লাখ ৪৫ হাজার ইউরো। তার পেছনেই রয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিপণন প্রধানের মতো পদগুলো। সেগুলোতে বার্ষিক গড় বেতন ১ লাখ ৭ হাজার ৫০০ ইউরো থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজার ইউরো। এদেশে একজন শ্রম আইন বিষয়ক আইনজীবীর বছরে গড় রোজগার ১ লাখ ৫ হাজার ইউরো। সিস্টেম অ্যাপ্লিকেশন প্রোডাক্ট বা স্যাপ পরামর্শকদের গড় আয় ১ লাখ ইউরো। টেক ইঞ্জিনিয়াররা বছরে ৯৫ হাজার ইউরোর মতো আয় করেন। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বছরে আয় গড়ে ৯০ হাজার ইউরো। ব্যবস্থাপক ও পরিচালকদের বেতন বছরে ৯০ হাজার ইউরো। দন্ত চিকিৎসকরা বছরে গড়ে ৮৬ হাজার ইউরো রোজগার করেন।
ফ্রান্স: ফ্রান্সে আয়ের দিক থেকে শীর্ষে দন্ত চিকিৎসকরা। তাদের বছরে গড় আয় ৯৫ হাজার ইউরো। তার নিচেই রয়েছেন অর্থোডন্টিস্টরা, তাদের আয় গড়ে ৭৮ হাজার ৭৫০ ইউরো। প্রযুক্তি খাতের নেটওয়ার্ক আর্কিটেক্টরা বছরে গড়ে ৭২ হাজার ৩৬১ ইউরো বেতন পান। মেডিকেল টেকনিশিয়ানদের গড় আয় ৭০ হাজার ইউরো। উৎপাদন খাতের একজন কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা বছরে ৬৭ হাজার ৫০০ ইউরো বেতন পান। ডোমেইন ম্যানেজার এবং বিক্রয় এজেন্টেরা ৬৪ থেকে ৬৫ হাজার ইউরোর মতো আয় করেন। তথ্য প্রযুক্তি খাতের পরামর্শক, যন্ত্র প্রকৌশলীদের বছরে বেতন হয় ৬২ হাজার ৫০০ ইউরোর মতো। বছরে ৬০ হাজার ইউরোর বেশি আয় করেন প্রকৌশলী, আবাসন খাতের এজেন্ট, বিক্রয় প্রধানদের মতো পদে আসীনরা।
যুক্তরাজ্য: যুক্তরাজ্যে শীর্ষ বেতনধারীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট পদগুলো এগিয়ে থাকলেও সবার ওপরে রয়েছে ফ্যাশন মডেলরা। তাদের বছরে গড় আয় ১ লাখ ৬৬ হাজার ইউরোর। আয়ের হিসাবে তাদের পরেই রয়েছেন মেডিকেল কনসালটেন্টরা, তাদের বছরে গড় আয় ১ লাখ ৪৬ হাজার ইউরো। স্বাস্থ্যসেবা পরিচালক ও রেডিওলজিস্টরা বছরে ১ লাখ ৩৭ হাজার ইউরোর মতো বেতন পান। স্বাস্থ্যসেবা খাতের অর্থোডন্টিস্টরা ১ লাখ ৩০ হাজার ইউরো, ক্লিনিক্যাল কনসালটেন্ট রা ১ লাখ ২৫ হাজার ইউরো, প্রধান নার্সরা ১ লাখ ২৪ হাজার ইউরো, সহযোগী ডেন্টিস্টরা ১ লাখ ১৬ হাজার ইউরো বেতন পান। প্রকল্প পরিচালক, মাইক্রেবায়োলজিস্টদের বছরে গড় বেতন হয় ১ লাখ ২১ হাজার থেকে ১ লাখ ২২ হাজার ইউরোর মতো।
নেদারল্যান্ডস: নেদারল্যান্ডসে ব্যবস্থাপনা, হিসাব রক্ষণ এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের পদগুলোতে বেতন সবচেয়ে বেশি। কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা ১ লাখ ১৫ হাজার ইউরোর মতো আয় করেন বছরে। বাণিজ্যিক পরামর্শকরা ৮০ হাজার ইউরো, প্রকল্প পরিচালকরা ৭৮ হাজার ইউরো, প্রকৌশলীরা ৭৫ হাজার ইউরো আয় করেন। বিপণন এবং প্রযুক্তি বিভাগের উঁচু পদধারীদের বছরে বেতন হয় ৫৬ হাজার ৫০০ ইউরো েথকে ৬৬ হাজার ইউরো। একই রকম আয় করেন বিক্রয় ব্যবস্থাপক, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ডেটা অ্যানালিস্টরা।
কোন পেশার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল?
চাকরির বাজার ক্রমাগতভাবেই বদলাচ্ছে। এখন যেগুলোর চাহিদা বেশি, সামনে দেখা যাবে সেগুলোর চাহিদা কমে নতুন কোনো পেশার চাহিদা তৈরি হয়েছে।
চাকরি সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ইনডিড’র গবেষণা পরিচালক পাওয়েল আদ্রিয়ান ইউরোনিউজকে বলেন, “আগামী ৫-১০ বছরে হয়ত দেখা যাবে গ্রিন এনার্জি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআইর মতো খাতগুলোতে চাকরি হবে সবচেয়ে বেশি বেতনের।”
অনেক চাকরি বিলুপ্ত হবে যেমন, আবার অনেক নতুন কাজের ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্যসেবার মতো পেশার ভূমিকা গুরুত্ব নিয়েই থাকবে বলে মনে করা হয়।
প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতার বিকাশও চাকরির বাজারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আদ্রিয়ান বলেন, “বিকাশমান বাজারে দ্রুত শেখাটা অপরিহার্য। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে যারা তালমিলিয়ে চলতে পারবেন, তারাই প্রতিযোগিতায় নিজেদের শক্ত অবস্থানে রাখবেন।”
চাকরির বাজারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের গুরুত্ব এখনও থাকলেও কিছু কিছু পেশায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব কমে আসার প্রবণতা দেখার কথা জানান আদ্রিয়ান। তিনি বলেন, বিশেষ করে আইটি এবং ডেটা বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে ডিগ্রির চেয়ে দক্ষতােই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এখন।