দাউদ হায়দারের কাল, আর একালে তফাত কতটা?

কবি দাউদ হায়দার, নির্বাসনে থেকেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন তিনি।
কবি দাউদ হায়দার, নির্বাসনে থেকেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন তিনি।

দেশ থেকে নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার যেদিন জার্মানিতে জীবন থেকে নির্বাসন নিলেন, ঠিক তার দুদিন আগে একটি ঘটনা ঘটল বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের ধনবাড়িতে। পঞ্চাশ বছর আগে যে প্রেক্ষাপটে দাউদ হায়দারকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, ঘটনাটির সঙ্গে তার বেশ মিল।

‘নাস্তিকদের বই রাখা যাবে না’ ফেইসবুকে এমন ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করে ধনবাড়ির অভয়ারণ্য পাঠাগার থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, ডা. জাফর ইকবালসহ কয়েকজন লেখকের চার শতাধিক বই নিয়ে চলে যায় একদল ব্যক্তি, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন ইসলামী একটি সংগঠনের স্থানীয় এক নেতা।

৫০ বছর আগে একটি কবিতার জন্যও ইসলামী সংগঠনগেুলোর এমন রোষের মুখে পড়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল কবি দাউদ হায়দারকে। তারপর আর ফিরতে পারেননি তিনি। শনিবার জার্মানিতেই তার জীবনাবসান ঘটে।

দাউদ হায়দারের ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭৪ সালে; তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সংবিধানে মন্ত্র হিসাবে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল; ক্ষমতায় তখন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ।

কবি দাউদ হায়দারের শাস্তি দাবিতে ১৯৭৪ সালে ইসলামী সংগঠনের কর্মসূচি নিয়ে বাংলার বাণীর প্রতিবেদন।

সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক দাউদ হায়দার ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি একটি কবিতা প্রকাশ করেন তার পত্রিকার রোববারের সাময়িকীতে। এর শিরোনাম ছিল- কালো সূর্যের কালো জোৎস্নার কালো বন্যায়।

এই কবিতায় ইসলাম অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে তখন মাঠে নেমে পড়ে ইসলামী সংগঠনগুলো। মিছিল শুরু হয় দাউদ হায়দারকে গ্রেপ্তারের দাবিতে। দাউদ হায়দারের শাস্তির দাবিতে তার জন্মস্থান পাবনায় হরতালও ডাকা হয়।

মাদ্রাসা ছাত্র পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনের পাশাপাশি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থীও দাউদ হায়দারের শাস্তি দাবি করে সমাবেশ করেছিল।

এই সব কর্মসূচিতে সমর্থন দেন ন্যাপ-ভাসানীর নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মতো ব্যক্তি, যিনি একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন।

ওই বছরের ১২ মার্চ বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে মিছিল নিয়ে দাউদ হায়দারের পত্রিকা সংবাদের অফিসেও হামলা হয়েছিল। সেই খবর দিতে গিয়ে তখনকার প্রভাবশালী নেতা শেখ ফজলুল হক মনির পত্রিকা বাংলার বাণী শিরোনাম করেছিল- ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে’। সেই প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছিল, বাংলাদেশের সংবিধানের মূল নীতিতে কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে একাত্তরে ধর্মের নামে পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া শক্তিগুলো।

কিন্তু তখন আওয়ামী লীগ সরকার দাউদ দায়দারকে রক্ষা করতে নামেনি। ইসলামী দলগুলোর দাবির মুখে ১১ মার্চই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তার দুই মাস পর ২০ মে মুক্তি দিয়ে তাকে বিমানে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতায়।

বলা হয়, তখন দাউদ হায়দারের চেয়ে মুসলিম দেশগুলোর স্বীকৃতি আদায়ই ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

কান্নায় ভিজে দেশ ছাড়তে হয়েছিল দাউদ হায়দারকে। তিনি পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার কোনো উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।”

আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাসনে পাঠানোর পর জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের শাসনকাল এলেও দাউদ হায়দারকে পাসপোর্ট তারা কেউই দেননি, বারবারই নাকচ হয়েছে এই কবির আবেদন।

দাউদ হায়দারকে নির্বাসনে পাঠানোর ঠিক ২০ বছর পর ১৯৯৪ সালে একই ঘটনা ঘটে তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে। তখন ক্ষমতায় বিএনপির খালেদা জিয়া।

তসলিমা নাসরিনের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ১৯৯৪ সালে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে সমাবেশে মাওলানা ওবায়দুল হক।

লেখালেখির জন্য তসলিমার ওপরও ক্ষেপে ওঠে ইসলামী দলগুলো। গঠিত হয় সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ, যার নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা ওবায়দুল হক। তার ছেলে মামুনুল হক এখন হেফাজতে ইসলামের নেতা হিসাবে বাবার ধারায় চলছেন।

তসলিমা নাসরিনের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়, সেই সঙ্গে তখন আওয়াজ ওঠে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের। তখনকার পরিস্থিতি উঠে আসে ভাস্কর শামীম সিকদারের এক লেখায়; যেখানে তিনি বলেন, “তসলিমা নাসরিনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হচ্ছে। ড. আহমেদ শরীফের ফাঁসি দাবি করা হচ্ছে। এগুলো সবই হচ্ছে ধর্মের নামে। এই যদি বর্তমান অবস্থা হয়, তাহলে ব্লাসফেমি আইন পাস হলে পরিস্থিতি কতটুকু ভয়াবহ হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।”

তাদের দাবির মুখে তসলিমা নাসরিনকে নির্বাসনে পাঠায় বিএনপি সরকার, এখনও তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। তখন আওয়ামী লীগকেও পাশে পাননি তসলিমা।

তিনি পরে একটি লেখায় বলেছেন, “আমার একটি প্রশ্ন, এ সময় আওয়ামী লীগ কী করছে? … বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি আর জামাতের সঙ্গে আঁতাত করেছে, এখন আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করাই মূল বিষয়। জামাতের বিপক্ষে গেলে জামাত আওয়ামী লীগের দাবিকে সমর্থন জানাবে না, না জানালে আওয়ামী লীগের সম্ভব হবে না আন্দোলন জোরদার করার। সুতরাং আওয়ামী লীগ এখন মরে গেলেও জামাতের বিপক্ষে একটি শব্দও উচ্চারণ করবে না।”

খালেদা জিয়া নির্বাসনে পাঠালেও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় যাওয়ার পর দেশে ফিরতে চেয়েও পারেননি তসলিমা।

গত বছর অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাই তসলিমা ফেইসবুকে লিখেছিলেন, “আমার মাকে মৃত্যুশয্যায় দেখতে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর ইসলামপন্থিদের খুশি করার জন্য হাসিনা আমাকে আমার দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলেন এবং আমাকে আর কখনও দেশে প্রবেশ করতে দেননি। একই ইসলামপন্থিরা ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে হাসিনাকে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে আজ।”

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে শুধু আওয়ামী লীগ সরকারেরই পতন হয়নি; বাংলাদেশের উল্টোযাত্রাও শুরু হয়েছে বলা যায়। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দেওয়া হয়েছে, সংবিধানের সঙ্গে দেশের সাংবিধানিক নামও বদলে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে।

তার মধ্যে তৌহিদী জনতা ব্যানারে নানা স্থানে মেয়েদের খেলা, গান-নাচের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ইসলামী দলগুলোর নেতারা অনৈসলামিক কিছু করতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে চলেছেন।

তার ধারাবাহিকতায় টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে অভয়ারণ্য পাঠাগারে বই লুট হলো বাংলাদেশ যুব খেলাফত মজলিসের উপজেলা সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম রব্বানীর নেতৃত্বে। গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে এই ঘটনা ঘটে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

জামালপুরের অভয়ারণ্য পাঠাগার, যেখান থেকে বই তুলে নিয়ে যায় একটি ইসলামী সংগঠনের নেতারা।

প্রথম আলো জানায়, গোলাম রব্বানী গত ২৪ এপ্রিল সকালে ফেইসবুকে এক পোস্টে লেখেন- “ধনবাড়ীতে নাস্তিক্যবাদের কোনো জায়গা হবে না। এটাই ফাইনাল বক্তব্য আমাদের। নাস্তিক বানানোর এক কারখানার সন্ধান পেয়েছি আমরা। অতি দ্রুত আপনাদের কারখানায় তালা লাগিয়ে ধনবাড়ী ছাড়ুন।”

এরপর সেই রাতেই খেলাফত মজলিসের যুব সংগঠনের নেতাকর্মীরা বাঁশহাটি এলাকায় অভয়ারণ্য পাঠাগারে হামলা চালায়। তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, জাফর ইকবালসহ কয়েকজন লেখকের চার শতাধিক বই রিকশায় নিয়ে যায়। এরপর রব্বানী ফেইসবুকে আবার লেখেন, “জয়বাংলা কর্মসূচি। বি:দ্র: যাদের বোঝা দরকার তারা বুঝতে পারছে।”

গোলাম রব্বানী প্রথম আলোর জিজ্ঞাসায় বলেন, “পাঠাগারটির সদস্যরা ইসলামবিদ্বেষী লেখা ফেইসবুকে পোস্ট করতো। পাঠাগারে হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন আহমেদ, ডা. জাফর ইকবালসহ বিভিন্ন লেখকের বই ছিল, যেগুলোতে নারীদের অধিকার, ইসলাম বিদ্বেষ নিয়ে লেখা ছিল। সেসব বইগুলো নিয়ে ইউএনও অফিসে জমা দিয়েছি।”

অভয়ারণ্য পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক দূর্জয় চন্দ্র ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, “গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে একদল যুবক পাঠাগারে এসে বই বস্তায় তুলতে শুরু করেন। তারা হুমকি দিয়ে বলেন, এখানে কোনো পাঠাগার থাকতে দেবেন না। বই পুড়িয়ে ফেলবেন।

“এসময় ধনবাড়ী থানার একজন কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত হলে তারা বইগুলো না পুড়িয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে জমা দেন।”

ধনবাড়ীর পাশের উপজেলা মধুপুরে গত ১২ ফেব্রুয়ারি লালন স্মরণোৎসব বন্ধ করে দিতে হয়েছিল হেফাজতে ইসলাম ও ওলামা পরিষদের চাপের মুখে।

এরেপর এখন অভয়ারণ্য পাঠাগারের বই তুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে কেউ কেউ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি পঙক্তি সামনে আনছেন, যেখানে তিনি লিখেছেন- “বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে/ বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি, ফেকা- হাদিস চষে’।

আরও পড়ুন