জন্ম সন্দ্বীপে হলেও হালিশহরের হাউজিং এস্টেটে তার বেড়ে ওঠা। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। ব্যাংকার বাবার সামর্থ্যে টান পড়ায় স্কুলে পাঠ শুরু এমন একটি প্রতিষ্ঠানে যেখানে ছিল না শিশুদের বসার ন্যূনতম ব্যবস্থা।
সেই দৈন্য স্মৃতি আজও হাতড়ে বেড়ান জীবনের বহু ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে আসা প্রবাসী ফছিহুল আজম। বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ রীতিমতো ‘ছিনিয়ে’ এনেছেন তিনি।
কাজ করেছেন নোকিয়া, বেল ল্যাবস, ইন্টেলের মতো নামী প্রতিষ্ঠানে।
কিন্তু কীভাবে পৌঁছুলেন লক্ষ্যে, কীভাবে মোকাবেলা করলেন দেশে এবং বিদেশে হাজারো প্রতিবন্ধকতা? এ লেখায় সেসব অজানা গল্প জানবো ফছিহুল আজমের ভাষ্যে।
মিস্টার ফছিহুলের ভাষায়, “আমার শুরুটা এমন একটি স্কুলে যেখানে অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের কেউ পারতপক্ষে পড়তে আসতো না। বসতে হতো মাদুর পেতে।”
অনটন ছাড়েনি লেখাপড়ার পুরোটা সময়। মামার অফিসের ফটো কপিয়ারের নষ্ট হয়ে যাওয়া কাগজের অপর পিঠে লিখে এসএসসির গণ্ডি অতিক্রম।
কলেজেও খুব ভালো কিছু করতে পারেননি। ‘টেনেটুনে’ প্রথম বিভাগ।
“গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক আমাকে অন্যান্য বিষয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেয়। তাই এইচএসসি খুব ভালো হয়নি। এক নম্বর গ্রেস নিয়ে প্রথম শ্রেণি পাই।”
ফছিহুলের লেখাপড়ার পুরোটা সময়ই ছিল রীতিমতো প্রতিকূলতায় ঠাসা। সরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও সুযোগ মেলেনি তার। মিলবে কীভাবে, আবেদন করার মতো আর্থিক সংগতি যেমন ছিলো না, তেমনি ছিলো না প্রয়োজনীয় নম্বর।
দূর সম্পর্কের এক প্রবাসী আত্মীয়ের অনুদানে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, চিটগং নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিকমিউনিকেশন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন তিনি। ভর্তির জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন ওই আত্মীয়। এরপর অবশ্য ঋণ করে তার বাবা চালিয়ে নেন।
ফছিহুল বলেন, “আমি ভাবতেও পারিনি কেউ আমার মতো একজনের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসবে! সত্যি বলতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সংগতি আমার বাবার ছিলো না। সেসময় সেখানে কেবল তারাই পড়তো যারা কোথাও সুযোগ পেতো না।”
অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। অচেনা, নামহীন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাল্টি ক্যারিয়ার সিডিএমএ’ প্রযুক্তি নিয়ে স্নাতকের থিসিস করে তাক লাগিয় দেন শিক্ষকদের।
তার ভাষায়, “শিক্ষকরা ভাবতেই পারেননি আমি নিজে এরকম কাজ করতে পারি। সবাই ভেবেছে আমি অন্যের গবেষণাপত্র নকল করে থিসিস লিখেছি। তাই ফেল করিয়ে দিলেন।
“অথচ যখন ২.৫ প্রজন্মের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে, তখন আমি ভেবেছিলাম চতুর্থ প্রজন্ম নিয়ে।”
তিনি জানান, প্রত্যাখ্যাত হওয়া গবেষণাপত্র দিয়েই পরবর্তীতে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। চীনের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন।
চাকরির সন্ধানে সুকতলা ক্ষয়
না, ফছিহুল বাংলাদেশে কোনো চাকরি জোটাতে পারেননি। যেটা পেয়েছিলেন সেটা ছিলো ‘বিটিএস’ পরিষ্কার করার কাজ!
“চাকরি পাবো কোত্থেকে, মানুষ তো আমাদের সিভিই রাখতে চায় না। সবাই মনেকরে বেসরকারিতে পড়েছি, কী আর শিখেছি। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর একটা চাকরি পেলাম বিটিএস দেখভালের কাজ; গিয়ে দেখি বিটিএস রুম পরিষ্কারের কাজ সেটা।,” ক্ষোভ মেশানো কণ্ঠে স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন তিনি।
দেশত্যাগে মরিয়া চেষ্টা
সেই থেকেই দেশ ছাড়ার আপ্রাণ চেষ্টায় লেগে যান ফছিহুল। সফল হতে খুব বেশি সময় নেননি। সুযোগ পেয়ে যান সুইডেনের দুটি ও ফিনল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
টিউশন ফি না থাকায় মাত্র ৮০০ ইউরো নিয়ে ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডে পাড়ি জমান। লাপ্পেনরান্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিউনিকেশন্স সফটওয়্যারে ভর্তি হন।
কিন্তু কে জানতো জীবনে সবচেয়ে কঠিন সময় অপেক্ষায় ফছিহুলের জন্য।
“ফিনল্যান্ডে তখন চারদিকে মন্দা চলছে। কাজ নেই, টাকা নেই। পড়াশোনা চালাতে হলে তো থাকা-খাওয়ার আর্থিক সংগতি থাকা চাই। একদিকে আর্থিক চাহিদা, অন্যদিকে পড়াশোনার চাপ। এক একটা কোর্সে ফেল করতে শুরু করলাম। পাস করলেও দু’তিনবারের চেষ্টায়।”
অবাক হওয়ার মতো বিষয়, তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে পড়লেও ফছিহুলের নিজের কোনো ল্যাপটপ বা কম্পিউটার ছিলো না। প্রথম কম্পিউটার তিনি সংগ্রহ করেছিলেন এক বন্ধুর কাছ থেকে, তাও শুধু সিপিইউ। ডাস্টবিন থেকে সংগ্রহ করেন মনিটর, কিবোর্ড।
অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে না দিয়ে অন্যের ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসার অনুশীলন বিদ্যমান ফিনিশ সংস্কৃতিতে। প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো যে যার মতো নিয়েও যায়।
ফছিহুল বলেন, “সেই কম্পিউটারে কোডিং প্র্যাকটিস শুরু। সঙ্গে এক বাংলাদেশির দোকানে দৈনিক ১০ ইউরো পারিশ্রমিকে কাজ। ওই দোকানে বেচাকেনা না থাকার সুযোগটা কাজে লাগালাম। কাজের ফাঁকে জাভা স্ক্রিপ্ট প্রোগ্রামিংয়ের ভিত্তি তৈরি করি সেখানেই।”
বিদেশ জীবনে কখনো পরিচ্ছন্নকর্মী, কখনো আবাসিক হোটেলে ‘হাউজ কিপিংয়ের’ কাজ করতে হয়েছে তাকে। তবে মনোবল হারাননি। লাপ্পেনরান্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখে ২০১৩ সালে নতুন করে ভর্তি হন তাম্পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এর মধ্যে এক বিদেশীনির সঙ্গে প্রেম করে বিয়েও করে ফেলেন। কথায় আছে নিজেকে নতুন করে সাজানোর সবচেয়ে প্রায়োগিক উপায় হলো শহর পরিবর্তন করে ফেলা।
২০১৭ সালে তাম্পেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।
বিদেশে চাকরি
এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চাকরি পেতে খানিকটা বেগ পেতে হলেও দক্ষতা উন্নয়নের ফলে এক সময় ভালো চাকরি পেয়ে যান। অবশ্য মাঝে নিজের ‘স্টার্টআপ’ দাঁড় করানোর চেষ্টাও করেছিলেন। প্রথম চাকরি ২০১৯ সালে, ইলেক্ট্রোবিট নামে একটি প্রতিষ্ঠানে, যেখানে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।
ফছিহুল বলেন, “চ্যাটজিপিটির মতো একটি মডেল নিয়ে সেখানে কাজ শুরু করেছিলাম। আমাদের টিমকে ৭৫ হাজার ইউরো ফান্ড দেওয়া হয়।”
এরপর ২০২১ সালে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি যোগ দেন নকিয়ায়। নকিয়ায় ঢোকার পর থেকে তিনি ‘বেল ল্যাবে’ ঢোকার জন্য মরিয়ো হয়ে ওঠেন। চারবার চেষ্টার পর সফল হন। ২০২২ ডিসেম্বরে, রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে।
২০২৪ জুলাইয়ে অবশ্য বেল ল্যাবস ছেড়ে দিয়ে ইন্টেলে স্টাফ স্টাফ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। কাজের ক্ষেত্র: জিপিও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট।
সফলতার মন্ত্র
তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- এই যে এতো এতো বিপত্তি, বাধা, তারপরও একটি পর্যায়ে পৌঁছুলেন, অন্যদেরকে এ বিষয়ে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কিনা?
“লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারাই আমার কাছে সফলতা। মিশন থেকে পিছপা হওয়া যাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত সফল না হবো ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মাঝে অনেক ব্যর্থতা আসবে, তাই বলে হতাশ হলে চলবে না। নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে।
“গতিপথে অনেক নিত্য নতুন লোভনীয় প্রস্তাব আসবে, বিশেষ করে বিদেশে, সেসব দিকে নজর দিলে চলবে না। যেতে হবে নিজের লক্ষ্যে।”