শেখ হাসিনার ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে তার সরকারেরই মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খানের ফেইসবুক আইডি থেকে একটি পোস্ট আসার পর তা নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়।
খানিক বাদে সেই পোস্ট তো বটেই, আইডিটিই যায় উধাও হয়ে। তবে সেই পোস্টের রেশ থেকে যায় ফেইসবুকে আলোচনায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও এই সংক্রান্ত একটি খবর শেয়ার দেওয়ায় সবার কৌতূহল আরও বাড়ে।
এনিয়ে আলোচনার মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ফারুক খানের নামে ভুয়া পোস্ট ছড়াচ্ছে। কারণ কারাগারে থেকে কারও মোবাইল ফোন কিংবা অন্য ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগও নেই।
তবে ফারুক খানের এই পোস্ট ওয়ান-ইলেভেনের স্মৃতি আবার ফিরিয়ে আনছে। যখন আওয়ামী লীগ-বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতার মুখ দিয়ে নিজ নিজ দলের নেত্রীদের বিরুদ্ধে কথা বলিয়ে সেসব ভিডিও ছাড়া হতো।
ফারুক খান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটার সময় পর্যন্ত বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের নেতা, এমপি, মন্ত্রীদের অনেকে বিদেশে পালিয়ে গেলেও অনেকে ধরাও পড়েন। ফারুক খানকে গত ১৫ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা সেনানিবাস থানা এলাকা থেকে। তারপর বিভিন্ন মামলায় রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এখন তিনি কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
যা লেখা ছিল সেই পোস্টে
ফারুক খান কারাবন্দি থাকার মধ্যে তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক আইডিতে ৩ ফেব্রুয়ারি, সোমবার একটি স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। তার মিনিট দশেক আগে আইডির কভার ফটো পরিবর্তন করা হয়, সেখানে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ফারুক খানের সঙ্গে বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের একটি ছবি তোলা হয়।
স্ট্যটাসে লেখা হয়, “অনেক চেষ্টা করে অনলাইনে এসেছি। জেলের চার দেয়াল আমাদের নিজ সত্তার সামনে দাঁড় করায়। অনেক কিছু বলতে চাই, কিন্তু এখন সবই বলতে পারছি না। এতটুকুই বলবো শেখ হাসিনাকে নেত্রী মেনেছিলাম। কিন্তু আজকে তার হঠকারিতার জন্যেই আমাদের দলের এই পরিণতি। দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন এবং সর্বস্তরে শুদ্ধি অভিযান ব্যতীত কোনও ধরনের রাজনীতিতে ফেরা উচিত হবে না। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আর চাই না, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ফেরত চাই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।”
আলোচনা, পুরনো স্মৃতির জাগরণ
স্ট্যাটাসটি দেওয়ার কিছুক্ষণ পরপরই আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের এ নেতার ফেইসবুক আইডি ডিঅ্যাক্টিভ করে দেওয়া হয়। তার আগেই ওই পোস্টের নিচে মন্তব্যের ঘরে কেউ কেউ লেখেন ‘আইডি হ্যাকড’।
গ্রেপ্তার হয়ে বন্দি অবস্থায় একজন ব্যক্তি কীভাবে ফেইসবুক চালাতে পারে, সেই প্রশ্ন যেমন ওঠে। আবার বাংলাদেশে সবই সম্ভব বলে মন্তব্যও আসে কারও কারও কাছ থেকে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাংলাভিশনের একটি কার্ড শেয়ার দেন, যেখানে লেখা ছিল- “জেল থেকে ফারুক খানের পোস্ট- ‘শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আর চাই না’।” বাংলাভিশনের সেই পোস্টে ক্যাপশন ছিল- “কারাগারে বসে ফেসবুক চালাচ্ছেন সাবেক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান।”
ফারুক খান নিজে এই পোস্ট দিয়েছেন, না কি কোনও উদ্দেশ্য থেকে অন্য কেউ এটা দিয়েছেন, সেই সন্দেহ করেন অনেকে। আর এই সন্দেহের মধ্যে ওয়ান-ইলেভেনের স্মৃতি ফিরে আসে।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল। তখন দুই প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
তাদের রাজনীতি থেকে দূরে সরাতে তখন এসেছিল ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’। প্রথমে দলের মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা হয়েছিল দুই দলেরই শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতাকে হাত করে। আবার বন্দি কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের দিয়ে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তিও আদায় করা হয়েছিল।
তখন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আব্দুল জলিল, ওবায়দুল কাদেরকে যৌথবাহিনী তথা সেনাবাহিনী দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলানো হয়েছিল, যার ভিডিও আবার সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়, যা অনেকে প্রকাশ ও প্রচারও করেছিলেন।
তখন বিএনপি সরকারের আলোচিত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে দিয়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কথা বলানো হয়েছিল। তার একটি ভিডিও আবার সম্প্রতি ইউটিউবে ছাড়া হয় বাবর মুক্তি পাওয়ার পর।
ফলে ফারুক খানের এই পোস্ট ধরে তেমন সন্দেহ যেমন অনেকে করছেন, আবার ফারুক খানের পোস্টকে আসল ধরে নিয়ে তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবেও চিহ্নিত করছেন কেউ কেউ।
এক্ষেত্রে ১৯৭১ সালে ফারুক খানের ভূমিকার কথাও তোলা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ফারুক খান তখন সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি, বরং পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। পরে বন্দি বিনিময়ের সময় তিনি পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসেন।
ফারুক খান লেফটেন্যান্ট কর্নেল হয়ে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৮৬ সালে গোপালগঞ্জ-১ (কাশিয়ানী) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তারপর আর কোনো নির্বাচনে হারেননি তিনি।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকারে প্রথম মন্ত্রী করা হয় তাকে। এরপর দুটি সরকারে বাদ পড়লেও ২০২৪ সালের সরকারে আবার মন্ত্রী পদে ফেরেন তিনি। তবে সেই সরকার সাত মাসও টেকেনি।
ফারুক খানের ভাই আজিজ খান সামিট গ্রুপের কর্ণধার। তবে তিনি সিঙ্গাপুরে থাকছেন। ফোর্বস সাময়িকীর সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীর তালিকায় তার নাম রয়েছে।
কারা কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে ফাঁক
ফারুক খানের ফেইসবুক পোস্ট নিয়ে আলোচনার মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষ একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠায় বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে; স্বপ্রণোদিত হয়ে যেমনটা করতে সাধারণত দেখা যায় না।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “আপনাদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আজ সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) ফারুক খান নামে জনৈক ব্যক্তির ফেসবুক আইডির একটি পোস্টের স্ক্রিন শট শেয়ার করে তা কারাগারে আটক সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান কর্তৃক প্রচার করা হয়েছে মর্মে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
“কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করছে যে, কারাগার হতে এ ধরনের প্রচার বা ফেসবুক চালানো সম্ভব নয়। তিনি বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে আটক আছেন।”
কারা কর্তৃপক্ষ কীসের ভিত্তিতে দাবি করছে যে এই ফেইসবুক আইডি ফারুক খানের নয় বা এটি অন্য কোনো ব্যক্তির, তা বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট হয়নি।
কারাগারে বন্দিদের মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও বন্দিদের হাতে মোবাইল যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। সেটা কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেও আগে ঘটেছে। গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের কনডেম সেলে থাকা সাত খুনের আসামি নূর হোসেনের হাতেও মোবাইল ফোন পাওয়া যায় ২০২২ সালে, তখন কারা কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল।
ফলে ফারুক খানের হাতে মোবাইল পৌঁছনো সম্ভবপর নয় বলে কারা কর্তৃপক্ষ খালাস পেতে চাইলেও এই বিষয়ে তদন্ত করে দেখেছে কি না, তা জানায়নি কারা কর্তৃপক্ষ।
আবার ফেইসবুক একাউন্টের পাসওয়ার্ড পেলে বাইরে থেকেও কেউ চালাতে পারে, কারা কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তিতেও বাইরে থেকে পরিচালনার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া হয়নি। সেক্ষেত্রে এটি ফারুক খানের আইডি নয় বলাটাও প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “কারাগারে আটক কোনো বন্দির পক্ষে মোবাইল ফোন ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই বিধায় বর্ণিত আইডিটি সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান কর্তৃক কারাগার হতে পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
“তবে অন্য কেউ বা তার আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক ফারুক খান নামের আইডিটি পরিচালনা করছে কি না, তা কারা কর্তৃপক্ষ অবগত নয়। বিষয়টি অনুসন্ধান পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আনুরোধ জানানো হয়েছে।”
কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন পর্যন্ত ফারুক খানের আইডি-পোস্ট নিয়ে কিছু না বলায় কে, কীভাবে এই পোস্ট দিল, আবার কেনইবা একাউন্ট গায়েব করে দিল, তা রহস্যই থেকে যাচ্ছে।