রাত-দিনের দূরত্ব গোছাতে দিগন্ত ছড়ানো আলোকসজ্জাও যে অসহ্য হয়ে ওঠতে পারে তা এখানে আসার আগে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। যেমন বুঝে উঠতে পারিনি সরল সমীকরণের কঠিনসব বাস্তবতা। ক্রমেই ছোট হচ্ছে দিন, সেই সঙ্গে বিষাদের পুরুত্ব যেন স্থায়ীত্ব পেয়ে যাচ্ছে মনের আনাচে।
ফিনল্যান্ডে আসার পর থেকে যে বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে পীড়া দিয়েছে তা যতোটা না মাইনাস তাপমাত্রার সঙ্গে সখ্য, তার চেয়ে ঢের বেশি এই নাতিদীর্ঘ আর অন্ধকারময় দিন। সকাল হতেই দুপুর, দুপুর না পেরোতেই রাত। আর সন্ধ্যা তো পুরো দিন জুড়েই! দিন দুয়েক আগেও বাংলাদেশের সঙ্গে সময়ের পার্থক্য ছিল তিনঘণ্টা, ডে-লাইট সেভিংসের কারণে ব্যবধান বেড়েছে। ২৭ অক্টোবর থেকে ব্যবধানটা এখন চার।
গত কয়েক বছর ধরে একটা বিষয় আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে, এই যে ছোট্ট জনসংখ্যার এই দেশ, তারা বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মেলাতে কী পারছে? আমার দেশের কুমিল্লা জেলার জনসংখ্যাও তাদের চেয়ে এক লাখ বেশি। আমার মনে হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটি সচ্ছল এই দেশ চাইলে অনেক এগিয়ে যেতে পারতো যদি তারা একটু উদার নীতি নিয়ে এগোতো। অন্তত কানাডার মতো। বরাবরের মতো তাদের রপ্তানিখাত স্থবির। আভ্যন্তরীণ আয় যে বাড়ছে বিষয়টা তেমনও নয়। হু হু করে কমছে বাসাবাড়ির দাম। খোদ রাজধানীতেই কমেছে গতবারের এই সময়ের তুলনায় প্রায় ৮ পার্সেন্ট দাম। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় নতুন বাড়ি কেনার পুরনো চোখগুলোকে ঝাপসা চোখে খুঁজতে হচ্ছে ভাড়া বাড়ি! কস্ট-কাটের ফাঁদে পড়ে হরহামেশা চাকরি খোয়াচ্ছেন বড় বড় কর্পোরেট হাউজের কর্মীরা। নিত্য পণ্যের দামের কথা আর কী বলবো!
আমি আসলে অর্থনীতি তেমন ভালো বুঝি না। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে দুর্বলই মনে হয়েছে আমার কাছে।
যাই হোক, আমার মতো বিদ্যার্থীর বিষাদে ফিনিশদের জীবনের রঙ যে হালকা হওয়ার নয় তা বুঝি রাতের গভীরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জেগে ওঠা নাইট ক্লাব, পানশালায় টুংটাং শব্দ। সাধারণত ভোর ৪টা পর্যন্ত মেতে থাকে শহরের নাইট ক্লাবগুলো। পানশালা রাত ২টা। বেশ কয়েকবার ঢু মারার সাহস দেখিয়েছি আমি। নিজেকে রাঙাতে না পারি, ওদের রঙ উপলব্ধি করার প্রয়াস বলা যায়!
এখানে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, তীব্র ঠাণ্ডায় গাঢ় মেইকআপ আর ক্লিভেজ ভাসানো কিংবা আধখোলা বক্ষ নিয়ে মাঝরাতে একদম একা বাড়ির পথ ধরা মেয়েটার মনেও নিরাপত্তা নিয়ে এতটুকু সন্দেহ নেই। তবে লজ্জা পাই- যখন কোনো সুন্দরী পাশে এসে বলে- ’ডো ইউ হ্যাভ অ্য স্পেয়ার সিগারেট?’ আমি বরাবরের মতো কৃপণতা দেখিয়ে বলি- ‘আনতেক্সি, দিস ইজ দ্য লাস্টওয়ান।’ আসলে যারা নতুন আসে তাদের বেশিরভাগ এই সিগারেট-বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অর্থ সংকটে ওরা সিগারেট চেয়ে খায় বিষয়টা এমন নয়। ফিনল্যান্ডের আইন অনুযায়ী, বয়স প্রমাণ করে তবেই সিগারেট কিনতে হয় সবাইকে। সন্দেহ হলে পরিচয়পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক।
বললে এই বিষাদের দেশের নানা অভিজ্ঞতা কথা বলতে পারি। ইচ্ছে হয় না। রাত হয়ে আসছে। ধেয়ে আসছে আমার এক জানালা বিষাদ। এই রাতে আমাকে টানে আমার ঝিঁঝিঁ পোকার প্রাকৃতিক আলোকসজ্জা। চাঁদের একফালি হাসি।
মায়াবী চাঁদের জোছনায় স্নান করি না কতদিন। কতদিন সকালের মিষ্টি বাতাস গায়ে মাখি না। কতদিন হঠাৎ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে বলে উঠি না- ধূৎ ছাই, এই দেশটার আর কিছুই হবে না! কতদিন গলির ছোট্ট টং দোকানে অলস সময় কাটাই না, আড্ডায় মন কষাকষি হয় না কতদিন! কতদিন সিগারেট ভাগাভাগি করে খাই না! সত্যি বলছি- কতদিন ভালোবাসি না আমার আমিকে, সেকথা কেমনে বলি!
দেশে পেঁয়াজে ঝাঁজ বাড়তে পারে, চাল নিয়ে কূটচাল হতে পারে- তাও আমার নোনাধরা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটাই আমাকে টানে। টানে মায়ের হলুদমাখা শাড়ির গন্ধ। নির্ভেজাল হাসি।